পিনাকী রঞ্জন পাল
১৮৩১ সাল। ফ্রান্সের পূর্ব প্রান্তে পাহাড় ঘেরা একটা ছোট্ট গ্রাম, আরবয়। সকালের রোদে গা ডুবিয়ে একটা ছোট ছেলে আপন মনে খেলা করছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল কিছু দূরে একটা জটলার সৃষ্টি হয়েছে। খেলা ফেলে সেখানে হাজির হল ছেলেটি। কয়েকজন আগুনে একটা লোহার শিক্ পোড়াচ্ছিল। টকটকে লাল শিক্ দেখে নিকোলাই আতঙ্কে পালাতে চাইছে। কিন্তু কয়েকজন তাকে চেপে ধরে আছে। একটু পরে তারা সেই লাল লোহার শিকটা নিকোলাইকে যেখানে পাগলা কুকুর কামড়েছিল সেই ক্ষতস্থানে চেপে ধরল। আকাশ ফাটিয়ে আর্তচিৎকার করল নিকোলাই। যন্ত্রণায় তার সমস্ত শরীর গুটিয়ে যাচ্ছে। মাংস পোড়ার উৎকট গন্ধ, নিকোলাইয়ের যন্ত্রণার সেই বীভৎস দৃশ্য ছেলেটি সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে বাড়ি চলে এল। বাবার কাছে জানতে চাইল, ‘পাগলা কুকুর কামড়ালে গরম শিকের ছেঁকা ছাড়া অন্য চিকিৎসা কি নেই?’ ‘ন… না নেই’, ধীর অথচ গম্ভীর কণ্ঠস্বর তার বাবার। বাবার উত্তর শুনে ছেলেটির মন ভারী হয়ে উঠল। তারপর একদিন নিজেই এর ওষুধ বার করেছিল সে।
ছোট্ট বন্ধুরা, বলতো এখানে কার কথা বলা হচ্ছে? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো তোমরা, মহান বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের। যিনি সমগ্র বিশ্ববাসীর কল্যাণে নিজের জীবনকে মেলে দিয়েছিলেন। সেই সুন্দর মানুষটির সুন্দর জীবনের কথা বলা যাক সংক্ষেপে।
১৮২২ সালে খ্রিষ্টমাস দিবসের ঠিক দু’দিন পরে জন্ম হয়েছিল লুই পাস্তুরের। তাঁর পিতা ছিলেন জাতিতে সমার। কাজ করতেন নেপোলিয়নের সৈন্য দলে। একটু বড় হলে ১৮৩৮ সালে পাস্তুরকে পাঠান হল প্যারিসের একটি স্কুলে। সেখান থেকে যান বেসানকন’ -এর রয়েল কলেজে। ১৮৪০ সালে তিনি ব্যাচেলার অফ লেটারস ডিগ্রি পান। এরপর বেসানকন কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাথমেটিক্যাল মাস্টার হিসাবে বছর দুই থাকার পর পাস্তর ব্যাচেলার অফ সায়েন্স ডিগ্রি পান। এই সময় তিনি রসায়নও পড়েন। ১৮৪৮ সালে তিনি ডিজন-এ পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
১৮৪৯ সালের ২৯মে মেরী লরেন্টের সঙ্গে লুই পাস্তুর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৮৫৪ সালে পাস্তুর লিলিতে অধ্যাপনা করেন এবং ফ্যাকালটি অফ সায়েন্সের ডিন হলেন। অধ্যাপনা আর গবেষণা দুটোই পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছিলেন পাস্তর।
ছোট্ট শহর লিলিতে প্রচুর মদ তৈরির কারখানা ছিল। হঠাৎ দেখা গেল তৈরি করা মদে পচন ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডাক পড়ল পাস্তুরের। রাত জেগে চলল গবেষণা। ভাল ও পচা উভয় মদ পরীক্ষা করে তিনি বুঝলেন, এক ধরনের জীবাণুই ফলের রস থেকে তৈরি মদ পচার কারণ। বাতাসের এইসব জীবাণুরা অষ্টপ্রহর ঘোরাফেরা করে। মদ ব্যবসায়ীদের তিনি এই জীবাণুগুলোকে নষ্ট করার একটা পথও বাতলে দিলেন।
১৮৬৫ সালে ফ্রান্সে এক রোগের আক্রমণে রেশমশিল্প ধ্বংস হতে বসেছিল। ফরাসি সরকারের অনুরোধে পাস্তুর তিন বছরের মধ্যেই এই রোগের কারণ আবিষ্কার করে বাঁচালেন ফ্রান্সের রেশম শিল্পকে। ১৮৬৭ সালে পাস্তুর নিযুক্ত হলেন সরবোন’এ রসায়নের অধ্যাপক পদে।
জীবাণু তত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেন। এরপর থেকেই। ১৮৭৭ সালে তিনি অ্যানথ্রাক্স রোগের ওপর গবেষণা শুরু করেন। ১৮৮০ সালে তাঁকে চিকেন কলেরার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে। অনুরোধ করা হয়।
আমরা সকলেই জানি যে, হাইড্রোফোবিয়া বা জলাতঙ্ক রোগ হয় পাগলা কুকুর কামড়ালে। আর এর প্রতিষেধক ভ্যাকসিন তৈরি করেছিলেন লুই পাস্তুর। অ্যানথ্রাক্স এবং বিশেষত হাইড্রোফোডিয়ার গবেষণার ফলশ্রুতি হিসাবে ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাস্তুর ইনস্টিটিউট। অ্যানথ্রাক্স রোগটি প্রধানত হয় গরু আর ঘোড়ার। মারাত্মক এ রোগ এতই ছোঁয়াচে যে, শুধুমাত্র স্পর্শে, এমনকি যদি ওই রোগগ্রস্ত প্রাণীর একটি মাত্র চুলও মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তা হলে তা ওই মানুষের শরীরেও ওই রোগ ঘটায়।
১৮৯২ সালের ২৭ ডিসেম্বর বিশ্বের সমস্ত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি লুই পাস্তুরকে শ্রদ্ধা জানাতে প্যারিসে উপস্থিত হয়েছিলেন। রাশি রাশি সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়া সত্ত্বেও পাস্তুরের মন ছিল শিশুর মত সরল। ১৮৯৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর শান্তির প্রতীক, মানবতার পূজারী, অক্লান্ত কর্মী বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর চিরকালের জন্য অবসর নেন। চিরনিদ্রায় শায়িত লুই পাস্তুর আজও যেন বলছেন কাজ করে যাও, কখনও কাজ থামিও না। ফ্রান্সের জনসাধারণের ভোটে পাস্তুর বিবেচিত হয়েছিলেন সর্বকালের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। ফ্রান্সের জনগণের আদর্শ নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সেই ভোটে পঞ্চম হয়েছিলেন।