ল্যুবেনহোয়েক

পিনাকী রঞ্জন পাল

চোখ যে সত্যিই আমাদের দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে একটি অমূল্য রত্ন সে কথা সকলেই মানেন। চোখ ছাড়া এই পৃথিবীতে জন্মানর দুঃখ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু চোখ থাকলেই কি আমরা এই দৃশ্যজগতের সবটাই দেখতে পাই? তোমরা হয়ত বলবে, ‘হ্যাঁ।’ এটা ঠিক নয়, আলোর একটা কেবল সামান্য অংশের অস্তিত্বই আমাদের চোখে সাড়া জাগায়, যাকে আমরা বলি দৃশ্য আলো। এ ছাড়াও রয়েছে প্রচুর বস্তু যাদের আকার এত ছোট যে সেগুলো আমাদের চোখের নাগালের বাইরে। এক মিলিমিটরের দশ ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত ব্যাসের কোন বস্তুকে খালি চোখে দেখা সম্ভব। তার থেকে ছোট যা কিছু জগতে আছে খালি চোখে তাদের আমরা দেখতে পাই না।

আমাদের চোখের ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষ বহুদিন পূর্বেই সচেতন হয়েছে। আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছ’শ বছর আগেই কাঁচ ঘষে লেন্স তৈরি করার কৌশল মানুষ রপ্ত করে ফেলেছিল। আর এই লেন্স চোখের সামনে বসিয়ে একদিন মানুষ বানিয়ে ফেলে চশমা। ক্ষুদ্র বস্তুর সামনে একটা উত্তল লেন্স রাখলে বস্তুটিকে বেশ বড় দেখায়, এই অভিজ্ঞতাই মানুষকে সেই রকম একটা যন্ত্র আবিষ্কারের পথে নিয়ে গেল— যাকে আজ আমরা বলি অণুবীক্ষণ যন্ত্র বা মাইক্রোস্কোপ (Microscope)। ছোট বন্ধুরা, আজ তোমাদের এই যন্ত্রটির সম্পর্কে দু-চার কথা জানাব।

নেদারল্যান্ডের জ্যাকারিয়াস জ্যানসেন ১৫৯০ খ্রীষ্টাব্দে অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু যন্ত্রটিকে প্রকৃত ব্যবহারের উপযুক্ত হিসেবে তৈরি করেছিলেন অ্যান্টন ল্যুবেনহোয়েক। এই ল্যুবেনহোয়েক (Lubenhoek) কিন্তু কোন বিজ্ঞানী নন, এমনকি, মোটামুটি শিক্ষিতও ছিলেন না। তিনি ছিলেন ডেফুট শহরের একজন ক্ষুদ্র শুকনো ফল বিক্রেতা।

এক গ্রীষ্মের দুপুরে ডাচ্ দোকানদার ল্যুনেহোয়েকের বাড়ির ছোট্ট বসবার করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গলদঘর্ম হয়ে অপেক্ষা করছে একবার সেই যন্ত্রটাতে চোখ দিয়ে দেখবে, যার নিচে কিলবিল করে নড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য জীবাণু। এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হিসেবে সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন দু’জন ধর্মযাজক, যাঁরা অবিশ্বাসী মন নিয়ে এসেছিলেন অনেকটা মজা দেখতে। পরে অবশ্য তাঁরা রয়্যাল সোসাইটিকে লেখা এই আবিষ্কারের রিপোর্টে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সই করেছিলেন।

১৬৭৪ খ্রীষ্টাব্দে এই আবিষ্কারের রিপোর্ট পাঠাবার পরেও রয়্যাল সোসাইটি সামান্য শুকনো ফলের দোকানদারকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু অনেক লোক আছেন যাঁরা কিছু ধরলে তার শেষ না দেখে ছাড়েন না। ল্যুবেনহোয়েক ছিলেন এমনই একজন নাছোড়বান্দা মানুষ। তিনি তাঁর নতুন যন্ত্রটিকে নিয়ে পোকামাকড়, গাছপালা, মলমূত্র যা পান তাই তার নিচে রেখে চোখ রাখেন। এই করেই তাঁর ব্যবসা বাণিজ্য শিকেয় একরকম উঠল।

ইতিমধ্যে একদিন ল্যুবেনহোয়েক ডেফট শহরের খুব বড় চিকিৎসক রেনার দ্য গ্রাফকে ডেকে তাঁর যন্ত্রটির ব্যবহার দেখালেন। দ্য গ্রাফই হলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এই যন্ত্রটির কদর যথাযথভাবে উপলব্ধি করলেন। শুধু তাই নয়, তিনি নতুন করে ল্যুবেনহোয়েককে দিয়ে এই আবিষ্কারের রিপোর্টে লিখিয়ে তা লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে পাঠালেন তাঁর নিজের সুপারিশ সমেত। রয়্যাল সোসাইটিতে ল্যুবেনহোয়েকের আবিষ্কার স্বীকৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে।

এদিকে ল্যুবেনহোয়েক তাঁর যন্ত্রে চোখ রেখে বসে আছেন দিবারাত্র, আর দেখেই চলেছেন অসংখ্য নতুন নতুন জীবের চেহারা, যারা প্রত্যেকেই ক্ষুদ্রতম কীট-পতঙ্গের থেকেও হাজার হাজার ভাগ ছোট। ১৬৮০ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির সভ্য নির্বাচিত হলেন। ল্যুবেনহোয়েকের ছোট্ট বাড়িতে সেই যন্ত্রটিতে চোখ রেখে বদ্ধ জলে জন্মান জীবাণু দেখতে এসেছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা ও রানী, জার্মানির সম্রাট সহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি।

অবশেষে ৯০ বছর বয়সে একদিন ল্যুবেনহোয়েক তাঁর নিজের ফুসফুসের রোগের জীবাণুকেও শনাক্ত করলেন। এ সম্পর্কে দু’টি চিঠিতে তিনি রয়্যাল সোসাইটিকে তাঁর রোগ সম্বন্ধে নিজের মতামত জানিয়েছিলেন। ১৭২৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ আগস্ট এই রোগেই মৃত্যু হয় ল্যুবেনহোয়েকের। জন্ম হয় একটি যন্ত্রের—যা শুধু বিজ্ঞানের নয় আমাদের জীবনেরও এক অপরিহার্য সঙ্গী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *