লেখক পঙ্কজ সেন
জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত রাজগঞ্জ ব্লকের বেলাকোবা বাজার থেকে মাত্র দুই কিমি দূরে শিকারপুর চা বাগানের মধ্যে অবস্থিত সন্ন্যাসী হাট বা “সন্ন্যাসী কাটা”। এখানেই রয়েছে দেবী চৌধুরানী বা ডাকাত সর্দার ভবানী পাঠকের মন্দির। বৌদ্ধ প্যাগোডার অনুকরণে সপ্ত চাল বিশিষ্ট এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর রাজবংশের রাজা দর্পদেব রায়কত(১৭২৮-১৭৯৩)।

মন্দিরটি এতদঞ্চলে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রভাবে শতবর্ষ ধরে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীকে ঘিরে একটি মিথ তৈরি করে ফেলেছে। ফলে এটি “দেবী চৌধুরানীর মন্দির” বলেও পরিচিত।

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের “দেবী চৌধুরানী” উপন্যাসের পটভূমি এই বৈকন্ঠপুর বনাঞ্চল। কথিত আছে যে, এই দুর্গম অঞ্চল শাসন করতো দেবী চৌধুরানী এবং ভবানী পাঠক। ভবানী পাঠক জনগণের কাছে ডাকাত সর্দার হিসেবে পরিচিত থাকলেও বাস্তবে তিনি সন্নাসীর মতোই জীবনযাপন করতেন। তিনি পার্শ্ববর্তী এলাকার অত্যাচারী জমিদার ও ইংরেজদের মূল্যবান সম্পত্তি এবং অর্থ লুঠ করে পরবর্তীতে তা দীন-দুঃখিদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। এই কারণেই জনমানষে দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠকের ভালোই প্রভাব ছিল।

ভবানী পাঠক কালী মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। শোনা যায়, প্রথমে এই মন্দিরের দুই পাশে দুটি কাঠের কালী মূর্তি ছিল। এই কাঠের মা কালী পুজো করেই ভবানী পাঠক ও তার দলবল অভিযানে বের হতেন।ঐতিহাসিক এই মন্দিরে মা কালীর মূর্তি ছাড়াও তিস্তা বুড়ি,ভবানী পাঠক,দেবী চৌধুরানী,গঙ্গা দেবী এবং সিদ্ধপুরুষ মোহনলালের মূর্তি আছে। মন্দিরের ভেতরের মূর্তিগুলি কাঠের এবং তার শিল্পকলা অপূর্ব ছিলো। মহাদেব-পার্বতী মূর্তিতে মহাদেবের মাথায় সাপ নেই। এই মূর্তির উভয় দিকে দুজন নারী ও দু’জন প্রহরী দণ্ডায়মান,এ ছাড়াও একদিকে শৃগাল এবং অন্যদিকে অর্ধশায়িত ব্যাঘ্রমূর্তি আছে।

স্থানীয় মানুষদের কথা অনুযায়ী ভবানী পাঠক দেবী চৌধুরানী কে নিজের মেয়ে হিসেবে মেনে ছিল। এই মন্দিরে প্রবেশপথে দুটো পিতলের ঘন্টা এবং ছোট ঘন্টাটিতে লাল বাহাদুর থাপা’র নাম দাতা হিসেবে খোদিত আছে। ২৫ জুন ১৯২৭ তারিখটি খোদিত থাকার ফলে অনুমান করা হয় যে, মন্দিরটি ওই তারিখেই পুনর্গঠিত হয়েছে। জলপাইগুড়ির অনেক দর্শনীয় স্থানের মধ্যে শিকারপুর চা বাগানের মধ্যে অবস্থিত এই মন্দির অন্যতম।

উল্লেখ্য যে শিকারপুর ও ভান্ডারপুর চা বাগান দুটি প্রতিষ্ঠা করেছেন জলপাইগুড়ির বৈকন্ঠপুর রায়কত রাজবংশের সর্বশেষ রাজা প্রসন্নদেব রায়কত। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে মন্দিরের বাৎসরিক পূজা খুবই জাঁকজমক সহকারে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু অপূর্ব সুন্দর এই ঐতিহ্যমন্ডিত মন্দিরটি ২০১৮ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ফলে মূর্তিসহ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেব অতিসত্বর মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নেন।

যদিও কাজের তদারকি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো উদ্যান ও কানন বিভাগকে। সেই বিভাগ থেকেই জলপাইগুড়ির একটি সংস্থা ২০১৯ সালে কাজ শুরু করে। বর্তমানে অবশ্য নবগঠিত এই মন্দিরটি জনগণের পূজা-অর্চনার উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। বিবরণীর সাথে প্রদত্ত ছবিটি পূর্বের মন্দিরের।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার – জলপাইগুড়ি পুরসভার ১২৫ তম বর্ষ স্মরণিকা।