পিনাকী রঞ্জন পাল : কখনো কি ভেবে দেখেছেন, হঠাৎ প্রজ্বলিত নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল কেউ কীভাবে হারিয়ে যায়, এবং তারপর কীভাবে আবার নতুন আলো ছড়ায়? এমনই এক অনুপ্রেরণার নাম করুণ নায়ার। ক্রিকেট দুনিয়ার অন্যতম প্রতিভাবান এই খেলোয়াড় একসময় হারিয়ে গিয়েছিলেন অন্ধকারে, কিন্তু আজ আবার ফিরে এসেছেন কক্ষপথে, এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে।
টেস্ট অভিষেকেই ট্রিপল সেঞ্চুরি : ২০১৬ সালের সেই স্মরণীয় দিনগুলোতে করুণ নায়ারের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্ব ক্রিকেটের আকাশে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে অভিষেকেই তিনি সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ট্রিপল সেঞ্চুরি—টেস্ট ক্রিকেটে এমন কীর্তি আগে ভারতীয়দের মধ্যে মাত্র দু’জন করেছিলেন। করুণ তখনই নিজের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর ব্যাটিংয়ে ছিল দৃঢ়তা, সাবলীলতা আর রান তোলার অদম্য ক্ষুধা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম খেলায়, এই প্রতিভাবান ক্রিকেটারের পথ অচিরেই বন্ধুর হয়ে ওঠে।
হারিয়ে যাওয়া এবং অন্ধকার সময় : টেস্ট ক্রিকেটে এমন চমকপ্রদ অভিষেকের পরও, করুণ নায়ারের জীবনে শুরু হয় দুঃস্বপ্ন। ব্যাটে রান পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন। আইপিএল এবং ঘরোয়া ক্রিকেটেও তেমন উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স করতে পারছিলেন না। একসময় নিজের রাজ্য কর্ণাটকও তাঁকে ভুলে যায়। চারদিকে যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সব দরজা।
ঘুরে দাঁড়ানোর সংকল্প : কিন্তু এখানেই করুণ প্রমাণ করেন, প্রতিভা হারিয়ে যেতে পারে না। নিজেকে আবার ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি লড়াই শুরু করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় কাতর আবেদন জানান, “কেউ কি আমাকে ক্রিকেট খেলার সুযোগ দেবেন?” দেশের হয়ে ছ’টি আন্তর্জাতিক টেস্ট খেলা এই ক্রিকেটার সহানুভূতি পেলেও, সমস্যার সমাধান হয়নি। তখনই করুণ স্থির করেন, প্রতিকূলতার দেয়াল যত শক্তই হোক, তাকে ভাঙতে হবে।
প্র্যাকটিস প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস : তিনি দিনরাত প্র্যাকটিস শুরু করেন। টানা দেড় বছর ধরে প্রতিদিন তিন ঘণ্টার জার্নি করে শুধু নেটে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করেছেন। তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন নিজের হারানো আত্মবিশ্বাস। কিন্তু তবু কেউ তাঁর দিকে তাকায়নি। কর্ণাটক দলে জায়গা পাননি। হতাশ হয়েও হাল ছাড়েননি করুণ। একসময় অনূর্ধ্ব উনিশ দলে তাঁর প্রাক্তন কোচ অবেয় কুরুভিল্লার কাছে সাহায্যের জন্য যান। এই প্রচেষ্টা সফল হয়। বিদর্ভ দলের হয়ে সুযোগ পান করুণ।
প্রত্যাবর্তনের গল্প : এ বছর বিজয় হাজারে ট্রফিতে করুণ নায়ার এমন এক পারফরম্যান্স উপহার দেন যা ক্রিকেট ইতিহাসে বিরল। খেলেছেন ছয়টি ম্যাচ। আর এই ছয়টি ইনিংসে পাঁচটিই শতরান। গড়ে ফেলেছেন সর্বকালীন রেকর্ডও ৷ এই টুর্নামেন্টে তাঁর রানগুলো ছিল অপরাজিত ১১২, ৪৪, ১৬৩, ১১১, ১১২, এবং ১২২। অবিশ্বাস্য হলেও, পুরো টুর্নামেন্টে একবারও আউট হননি তিনি। কোন বোলার তাকে আউট করতে পারে নি। বিজয় হাজারে ট্রফির একটি সংস্করণে সর্বাধিক শতরানের নিরিখে তামিলনাড়ু এন জগদীশনের (2022-23) সঙ্গে যুগ্মভাবে আপাতত শীর্ষে তিনি ৷ তাঁর কাছে সুযোগ রয়েছে সেমিফাইনাল-ফাইনালে আরও একটি শতরান হাঁকিয়ে নজির নিজের নামের করে নেওয়ার ৷ ক্রিকেট বোদ্ধারা বলছেন, ৩৩ বছর বয়সী করুণ এখন যেন এক “রান মেশিন”—তাঁর ব্যাট থেকে যেন থামতেই চাইছে না রান।
কড়া নাড়ছেন জাতীয় দলের দরজায় : গত প্রায় এক বছর ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ভারতীয় টেস্ট দলের ব্যাটিং। একাধিক তারকা আজ কার্যত অস্তাচলে। এই সংকটে করুনের ব্যাট বাধ্য করেছে, তাঁকে নিয়ে ভাবতে। আজ করুণ নায়ার কড়া নাড়ছেন জাতীয় দলের দরজায়।
অনুপ্রেরণার শিক্ষা : করুণ নায়ারের এই প্রত্যাবর্তন শুধু ক্রিকেট নয়, জীবনের ক্ষেত্রেও এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর গল্প আমাদের শেখায়, জীবনে কখনো হাল ছাড়া উচিত নয়। কখনো যদি পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়, তখন লড়াই করার মানসিকতাই পারে অন্ধকার কাটিয়ে আলোতে ফিরিয়ে আনতে।
করুণের এই যাত্রা প্রমাণ করে, প্রতিভা আর কঠোর পরিশ্রমের সম্মিলনে সবকিছুই সম্ভব। সময় এবং পরিস্থিতি যত কঠিন হোক, সঠিক লক্ষ্য স্থির করে লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই। করুণ নায়ারের মতো প্রত্যেকেই নিজের জীবনের নায়ক হতে পারে, যদি তারা বিশ্বাস করে এবং সেই বিশ্বাসে অটল থাকে।
তাঁর প্রত্যাবর্তন শুধু একটি ক্রীড়া কাহিনী নয়, এটি আমাদের সকলের জন্য এক চিরন্তন অনুপ্রেরণা।