ঢপ কল বা গম্বুজ কল ও জলপাইগুড়ি

লেখক পঙ্কজ সেন

আমাদের প্রিয় জলপাইগুড়ি শহরের আনাচে-কানাচে প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই আজও দেখতে পাওয়া যায় পুরনো দিনের জলপাইগুড়ি পুরসভা থেকে বসানো প্রায় ১০ ফুট উঁচু ও ৪ ফুট ব্যাসের বালি ও সিমেন্টের তৈরি ঢেউ খেলানো গোলাকার এক প্রকার কল। যা “ঢপ কল” বা “গম্বুজ কল” নামে পরিচিত। স্বাধীনতার আগে ১৯৩৪ সালে ইংরেজ আমলে অবিভক্ত বাংলার রাজসাহী জেলা সদরে সর্বপ্রথম এই কল স্থাপনের উদ্যোগ গৃহীত হয়। মূলতঃ শহরের নাগরিকদের জলের অভাব দূরীকরণের জন্য এবং জলবাহীত মহামারীর ভয়াল থাবা থেকে জনগণকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই এই কল নির্মান করা হয়। বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও ঐতিহ্যবাহী এই কল প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে, যদিও অল্প কিছু মাত্রায় এখনো সক্রিয়ভাবে টিকে আছে। ১৯৩৪ সালে রাজশাহীতে এই কল নির্মাণের সময় শহরবাসীর সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে এই পরিকল্পনায় বিপুল অর্থ ব্যয় করেন কুঠিয়ার মহারানী হেমন্ত কুমারী। তিনি এই উদ্দেশ্যে তৎকালীন সময়ে ষাট হাজার টাকা দান করেন। অবশেষে ১৯৩৭ সালে ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বসাধারণের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় “ঢপ কল”। রাজশাহীতে ঐতিহ্যবাহী এই কলগুলির অনেকগুলি বর্তমানে ব্যবহৃত না হলেও, তারা এখনো মাথা উঁচু করে রাজশাহী শহরের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী “বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম” এর ভিতরে এই কলটিকে অতি যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে লুপ্ত না হয়।

ছবিটি ওপার বাংলার রাজশাহী শহরের একটি কলের।

৪৭০ গ্যালন জল ধারণের ক্ষমতা রয়েছে এই কলগুলির। সেই সঙ্গে ছিল জল পরিশুদ্ধ করার উন্নত ব্যবস্থা। জলের ট্যাংকের (cylindrical tank) ভেতরকার একটা উপযুক্ত স্টিলের প্লেট দ্বারা আবৃত রয়েছে, এবং ওপরে ছিল লোহার ঢাকনি। ঢাকনির উপরে একটা বর্ষার মতো লোহার ফলা ছিল। বর্তমানে কিছু কিছু জায়গায় এই ঢাকনিটি চুরি হয়ে যাওয়ায়, সেখানে কংক্রিটের ঢাকনা লাগানো হয়েছে। স্বাধীনতার আগে ও পরে একটা দীর্ঘ সময় বাংলার জনগণের কাছে এই কলগুলির একটা অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। যদিও বর্তমানে, তাদের দিন প্রায় ফুরিয়েছে! চলে গেছে স্মৃতির মনিকোঠায়! সিমেন্টের তৈরি ঢেউ খেলানো গোলাকার এই কলের কাঠামোটি আমাদের অবিভক্ত বাংলায় নির্মাণ হলেও, তার ভেতরের সকল রকম যন্ত্রাদি আসতো সুদূর ইংল্যান্ডের সেফিল্ড থেকে জাহাজের মাধ্যমে।

ছবিটি জলপাইগুড়ি শহরের তিন নম্বর ওয়ার্ডের হাকিম পাড়ার

কলিকাতার উপকন্ঠে কামারহাটি পুরসভাতে এবং বরানগর অঞ্চলে আজও এই ধরনের কল দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে এটি “গম্বুজ কল” নামে পরিচিত। মালদার প্রাণকেন্দ্র ফোয়ারা মোড়, হায়দরপুর পিয়াজি মোড়, মকদমপুর ও মিরচক এলাকায় এই কল আজও কার্যকরভাবে টিকে আছে। বোলপুর, শ্যামনগর এবং কাঁচড়া পাড়াতে এখনও ঢপ কল দেখা যায়।

বর্তমানে জলপাইগুড়ি শহরের সেনপাড়া, হাকিম পাড়া, শিয়াল পাড়া, মোহন্ত পাড়া (কালী মন্দিরের সামনে), কামারপাড়া, রায়কত পাড়া, নয়া বস্তি, বেগুনটারি মোড়, ডি বি সি রোড, রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় এর সামনে, সোনাউল্লা স্কুলের পেছনে ইত্যাদি জায়গায় আজও ঢপ কল দেখা যায়। যদিও তার মধ্যে অনেকগুলি অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। ১৯৬৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর তিস্তার মহা বন্যায় সেন পাড়ায় জিলা স্কুল মোড়ে এই কলটির উপরে আশ্রয় নিয়ে জগন্নাথ সেন ও তার পরিবার নিজের জীবন বাঁচিয়ে ছিল।

প্রাচীন এই ঐতিহ্যকে আধুনিক ও স্থায়ীভাবে সংস্কার করে টিকিয়ে রাখাটা বর্তমানে সময়ের দাবি। জলপাইগুড়ি পুরসভার কাছে বিনীত অনুরোধ, শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত এই কলগুলিকে সংস্কার করে তার পূর্বস্থানে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুল আহ্বান জানাই। সর্বশেষে একটিই কথা,” ঢপকল তোমার জন্য দু ফোঁটা চোখের জল”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *