লেখক পিনাকী রঞ্জন পাল ১৯৯৯ সালে যখন এই লেখাটি লেখেন, তখন ঘরোয়া দূষণ নিয়ে সচেতনতা ছিল নগণ্য। ৩রা জুন, ১৯৯৯-এ উত্তরবঙ্গ সংবাদ-এর জ্ঞান-বিজ্ঞান পাতায় প্রকাশিত এই প্রবন্ধে তিনি যেভাবে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও বাস্তব ঘটনার মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরেছেন, তা নিঃসন্দেহে সময়ের অনেক আগের কথা। প্রায় দুই দশকের বেশি সময় পেরিয়ে এসেও আজ এই লেখাটি হয়ে উঠেছে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক—কারণ এখন প্রতিটি ঘরেই ঢুকে পড়েছে অসংখ্য বৈদ্যুতিক ও রাসায়নিক উপাদান, যেগুলোর গোপন দূষণ আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর চরম হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শিশুর মৃত্যু থেকে শুরু করে ক্যানসার, অনিদ্রা, ত্বকের রোগ—সব কিছুর পেছনেই লুকিয়ে থাকতে পারে এই অভ্যন্তরীণ দূষণ। তাই আজ, যখন পরিবেশ নিয়ে আমাদের ভাবনা আরও গভীর হওয়া উচিত, তখন এই লেখাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—ঘরের মধ্যেই কোথায় লুকিয়ে আছে মৃত্যুর ছায়া। এই প্রবন্ধ শুধু পাঠ নয়, একান্ত প্রয়োজনীয় চেতনা।

মোটরগাড়ি, কারখানা প্রভৃতি থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরনের বাহ্য দূষণ সম্পর্কে আমরা যতটা পরিচিত, ততটাই অপরিচিত বাড়ি, অফিস, দোকান, হোটেল প্রভৃতির চার দেওয়ালের মধ্যে ব্যপ্ত অভ্যন্তরীণ দূষণ সম্পর্কে। অবশ্য দূষণ বাহ্যই হোক অথবা অভ্যন্তরীণ- উভয়ই মারাত্মক ক্ষতিকারক। কিন্তু বাহ্য দূষণ স্পষ্ট দেখা যায় আর বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে গিয়ে যখন লোকের কাছে ঘরের পৌঁছায় তখন তার ঘনত্ব অনেক কমে যায়। বিপরীত দিকে অভ্যন্তরীণ দূষণ প্রায় সবই অদৃশ্য অবস্থায় থাকে আর চার দেওয়ালের মধ্যে থাকার জন্য এর ঘনত্ব বেশ বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় এটা এত বৃদ্ধি পায় যে প্রাণঘাতী রূপ ধারণ করে।
ঘরোয়া দূষণ দিনের পর দিন ভয়াবহ আকার নিচ্ছে, কেননা লোকেরা একদিকে গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্য এয়ার কন্ডিশনার এবং শীতের প্রভাব থেকে মুক্ত হবার জন্য হিটার, ব্রোয়ার প্রভৃতি ব্যবহার করে আর এগুলোর ঈপ্সিত প্রভাব পাবার জন্য। আবার, কয়েক বছর যাবৎ ঘরের কাজকর্মকে সরল করার জন্য অনেক ধরনের বৈদ্যুতিক উপাদান বাজারে এসেছে। গৃহিণীরাও এগুলো ব্যাপকহারে ব্যবহার করছেন, কিন্তু এ সমস্ত উপাদানই কোন না কোন ক্ষতিকারক গ্যাস কম অথবা বেশি পরিমাণে বের করে থাকে।
এ সমস্ত উপাদানের মধ্যে ফ্রিজ তো আগে থেকেই ছিল, এখন এই তালিকা আরো দীর্ঘ হয়েছে- মিক্সার গ্রাইন্ডার, ওয়াশিং মেশিন, ইলেকট্রিক ওভেন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, হেয়ার ড্রায়ার, টি ভি, ভি সি আর, সোডামেকার, কুকিং রেঞ্জ এমন কি পার্সেনাল কম্পিউটার পর্যন্ত। অফিসেও এই তালিকা আজ কম দীর্ঘ নয়- কম্পিউটার, ফটোস্টেট মেশিন, ফ্যাক্স মেশিন, এয়ার কন্ডিশনার প্রভৃতি। এ সমস্ত উপাদান থেকে নির্গত দূষণের পরিমাণ যখন একটি নির্দিষ্ট সীমাকে অতিক্রম করে তখন সেটা মারাত্মক ক্ষতিকারক হয় আর কোন অসুস্থ ব্যক্তি এই পরিবেশে থাকলে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে অতি দ্রুত।
কয়েক বছর আগে লণ্ডনে এক দম্পতিকে তাদের ফ্ল্যাটের বাথরুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাদের না তো কেউ হত্যা করেছিল আর না তো তারা আত্মহত্যা করেছিল। তবে এই দম্পতি মারা গেলেন কি করে? পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে জানা যায় তাদের মৃত্যু হয়েছিল ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে থাকা মারাত্মক মাত্রার দূষণের কারণে। তদন্তে দেখা গেল, সেই দম্পতি ড্রাইক্লিন করা চাদরকে বাথরুমে লাগানো হিটারের শিকে শুকোতে দিয়েছিলেন এবং এর ফলে চাদর থেকে নির্গত হয় বিষাক্ত বাষ্প। বাথরুমের মতো ছোট স্থানে সেই বিষাক্ত বাষ্প জমা হতে থাকে এবং এতো বেশি হয়ে যায় তা সেই দম্পতির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তদন্তে আরো জানা যায় যে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই যথাক্রমে হৃদয় এবং ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন বলে এই দূষণ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন অতি শীঘ্রই।
এই ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য ড্রাইক্লিন করা জামা-কাপড় আলমারিতে রাখার আগে অথবা গায়ে দেবার আগে খোলা হাওয়ায় মেলে রাখুন, যাতে তার মধ্যে থাকা বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে যেতে পারে। ড্রাইক্লিন করা জামা-কাপড়, এয়ার কন্ডিশন গাড়ি, যার জানালা বন্ধ থাকে তাতে বয়ে নিয়ে যাওয়াও কম মারাত্মক নয়। ড্রাইক্লিন করা জামা-কাপড় থেকে ট্রাইক্লোরো ইথিলিন নামক গ্যাস নির্গত হয়। এর মাত্রা বাতাসে যদি ১০০ পি পি এমে’র থেকে বেশি হয় তবে তা মানুষের শরীরে হানির কারণ হতে পারে। কিন্তু আলমারিতে রাখা ড্রাইক্লিন করা কাপড়ের স্থানে এই গ্যাসের মাত্রা ৪০০ পি পি এম পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যা সুরক্ষিত ঘনত্ব থেকে চার গুণ বেশি। এই গ্যাস বেশি মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, অনিদ্রা রোগ হতে পারে আর দীর্ঘক্ষণ ধরে এই রাসায়নিক গ্যাস শ্বাসনালী দিয়ে প্রবেশ করতে থাকলে। মৃত্যুও হতে পারে।
আজকাল তো ঘরে ব্যবহৃত উপাদান তথা সৌন্দর্য প্রসাধন থেকেও অনেক ক্ষেত্রে ক্রেতারা বিপদে পড়ছেন। আর এই ধরনের বিপদের সূচিও ক্রমবর্ধমান। কেননা নিজের ঘর-বাড়ি পরিস্কার- পরিচ্ছন্ন তথা জীবাণু মুক্ত রাখার জন্য, সুন্দর করে সাজাবার জন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিকের ব্যবহার মানুষ অধিক মাত্রায় করছেন। ঘরে জীবাণু নাশ করার জন্য ব্যবহৃত পেস্টিসাইড, স্প্রে, বৈদ্যুতিক উপাদান, বাথরুম পরিষ্কার করার ক্লীনার, সাবান, ডিটারজেন্ট, পেন্ট-পালিশ, নন স্টিক তথা অন্য এই ধরনের বাসন, পোকা তাড়াবার ন্যাপথলিন, মশা তাড়ানোর কয়েল তথা ম্যাট, রঙিন টেলিভিশন থেকে নির্গত বিকিরণ প্রভৃতি সবই ঘরের দূষণের কারণ।
ঘরের দূষণের সবচেয়ে বেশি দায়ি হলো কীটনাশক রসায়ন। পোকা-মাকড়ের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য কীটনাশকের ব্যবহার, ঘরে ব্যবহারের পাশাপাশি হোটেলের রান্নাঘরে, ফলের দোকান, মাংসের দোকান প্রভৃতিতে এর। ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে কোনো রকম সাবধানী ছাড়াই। এখানেই শেষ নয়, কীটনাশকের ব্যবহার গোশালায় পালতু প্রাণীদের ওপরেও করা হচ্ছে, এতে দুধে কীটনাশক ছড়িয়ে পড়ছে এবং শিশু আর ছোট ছেলেমেয়েদের পক্ষে যা অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা কীটনাশক থেকে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। কিন্তু এই তথ্য অধিকাংশ পিতা-মাতাই জানেন না। আর তাই নিজের শিশুর থাকার স্থান, খেলার স্থান তথা পড়ার স্থানেও প্রতিনিয়ত কীটনাশক ছড়াতে থাকেন যাতে তাদের শিশু পোকা-মাকড়ের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু বাস্তবে হয় এর উল্টোটাই। কয়েক বছর আগে দিল্লির একটি বাড়িতে শিশুকে শোয়াবার আগে তার মা বিছানায় কীটনাশকের স্প্রে করে দেয় যাতে ছারপোকা বা অন্য পোকারা শিশুটিকে আক্রমণ না করে। এরপর মা তার তিনটি শিশুকে তাতে শুইয়ে দেয়। কিন্তু সেই তিনটি শিশুর আর কোনো দিনও ঘুম ভাঙেনি।
ঘরে ব্যবহৃত উপাদানের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ডিটারজেন্ট পাউডারের। সাবান তৈরির জন্য যে কাঁচা তেল ব্যবহৃত হয় সেটা প্রয়োজনের তুলনায় কম পাওয়া যাওয়াতে পরম্পরাগত সাবান উৎপাদন কমে গিয়ে ডিটারজেন্ট সাবানের উৎপাদন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ডিটারজেন্ট সাবান আর পাউডারে পরস্পরাগত সাবানের বিপরীত এমন রাসায়নিক থাকে যা বায়োডিগ্রেডেবল নয়, এর ফলে নদী-নালা, হ্রদ, পুকুর প্রভৃতিতে দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ডিটারজেন্ট দিয়ে বাসন ধোওয়ার প্রথা চলছে যা ভীষন ক্ষতিকারক। কেননা খাবার তৈরি আর ভোজন করার বাসন ডিটারজেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করায় এর কিছু অংশ তাতে লেগেই থাকে। আর খাবার তৈরির সময় বা জল রাখার ফলে সেই পাত্রে লেগে থাকা ডিটারজেন্টের কিছুটা খাবার অথবা জলে মিশে যায়। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এইভাবে একজন ব্যক্তি আহারের সাথে প্রতিদিন ২ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ডিটারজেন্ট গ্রহণ করে। গরমের দিনে তো এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কেননা জলের অভাবে কম জল দিয়ে বাসন ধোওয়া হয়, আর মানুষরা অধিক পরিমাণে জল পান করে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, গরমে একজন মানুষ প্রতিদিন ৫ মিলিগ্রাম ডিটারজেন্ট গ্রহণ করে থাকে। এতো অল্প সংখ্যক ডিটারজেন্ট তো প্রথমদিকে কোনো ক্ষতি করে না, কিন্তু যখন এর মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখন সে তার ধ্বংসলীলা আরম্ভ করে। ডিটারজেন্ট থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ত্বক। ত্বকে জ্বলন, চুলকানি এমন কি ফোস্কা পর্যন্ত পড়তে পারে। এর থেকে মুক্তি পাবার জন্য দরকার ডিটারজেন্ট পাউডার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার না করা এবং ব্যবহারের সময় রাবারের দস্তানা পরে নেওয়া।
বহু ক্রেতা বিজ্ঞাপন দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে এয়ার পিউরিফায়ার’ এর ব্যবহার। বাথরুম, টয়লেট এমন কি অফিসেও লাগানো শুরু করেছেন। এই সমস্ত এয়ার পিউরিফায়ারে এক ধরনের কীটনাশক- পপ্যারাডাইক্লোরো বেঞ্জিন থাকে যা বাষ্প হয়ে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে আর বন্ধ ঘরে এর সীমা বিষাক্ত স্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এর গন্ধ যত তীব্র হবে ঘরে এর বাষ্প ততই বেশি হবে। এর তীব্র সুগন্ধ ঘরের ভেতরকার দুর্গন্ধকে সাময়িকভাবে চাপা দিয়ে দেয়, কিন্তু এর ব্যবহারে বাতাস শুদ্ধ না হয়ে বিষাক্ত হয়ে যায়।
ঘরের দূষণের অন্য একটি প্রধান কারণ হল স্পঞ্জ রাবার তথা ফোমের ব্যবহার। এই স্পঞ্জ রাবার শুধুমাত্র বিছানা আর বালিশ হিসাবেই নয়, সোফা, কম্পিউটার রাখার প্যাড হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। যে সমস্ত ঘরে এর ব্যবহার অধিক মাত্রায় হয় সেখানে হঠাৎ প্রবেশ করলে এক বিচিত্র ধরনের অনুভব হয়, কিছু লোকের তো অস্বস্তিও লাগে। এছাড়াও এই ধরনের গদি থেকে অ্যালার্জিও হয়ে থাকে। এই ধরনের বিছানায় শোয়ার জন্য মেরুদণ্ড প্রভাবিত হয় তথা উক্ত ব্যক্তি অনিদ্রা, ক্লান্তি, খিটখিটে স্বভাব প্রভৃতির শিকার হয়ে থাকে।
বার্ণিশ তথা রঙ থেকেও ঘর দূষিত হয়, বিশেষত যখন তাদের প্রয়োগ দ্রুত করা হয়। বার্ণিশ তথা রঙ থেকে ফার্মেন্ডিহাইড নামক কার্বনিক রাসায়নিক বাতাসে মিশে নিঃশ্বাসের দ্বারা শরীরে প্রবেশ করে ক্ষতি করে। তাই বার্ণিশ তথা রঙ করার পরে ঘরের দরজা, জানালাগুলি খুলে রাখা তথা পাখা চালিয়ে দেওয়া উচিত যাতে ক্ষতিকর গ্যাস বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে।
রান্নাঘরে ব্যবহৃত উপাদানও ঘরোয়া দূষণের কারণ। ফ্রিজ, মিক্সি গ্রাইন্ডার প্রভৃতি রান্নাঘরের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে চালালে তাদের মোটর থেকে অল্প মাত্রায় ওজন গ্যাস নির্গত হয়। এই ওজন গ্যাস অল্প মাত্রাতেও স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে বাতাসের দশ কোটি ভাগে যদি ওজন কেবলমাত্র পঞ্চাশ ভাগও হয় তবুও তা মানব জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে। আর অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে তো এটা মৃত্যুর কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। এছাড়াও জ্বলন্ত কয়লা, কেরোসিন তেলের খারাপ স্টোভ, হিটার, রঙিন টেলিভিশন, এয়ারকণ্ড মেশিন, ওয়াশিং মেশিন প্রভৃতিও ঘরোয়া দূষণের জন্য দায়ি।
ঘরের মধ্যে ধূমপান ঘরোয়া দূষণের অন্যতম, প্রধান সমস্যা। এ বিষয়ে সবাই জানলেও ঘর, অফিস, বাস, ট্রেন প্রভৃতির মধ্যে ধূমপান করে ধূমপায়ীরা নিজের সাথে সাথে আশে পাশের অধূমপায়ীদেরও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে চলেছে।
ছবি AI