অভাবের ঘনীভূত অন্ধকারেও বহুরূপী বাপির লড়াই থামেনি

বিশ্বজিৎ নাথ : হুগলির তারকেশ্বরের এক সরু গলিতে দিনের আলো ম্লান হয়ে আসে সন্ধ্যার ছোঁয়ায়। ঠিক তখনই, ধূসর রঙের ধুলো মেখে, কপালে চন্দনের ফোঁটা আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে মহাদেবের রূপ ধরে পথে নামেন বাপি ঘোষ। ছোট্ট ঝোলা হাতে দোকান থেকে দোকান, মোড় থেকে মোড় ঘুরে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন তিনি। এক মুহূর্তে মহাদেব, আবার পরদিন হন হনুমান, রাম কিংবা কালী। তবে এই রূপ বদলের নেপথ্যে একটিই সত্য—অর্থের জন্য বাঁচার লড়াই।

বাপি ঘোষ বহুরূপী পেশায় আছেন বহু বছর। এক সময় বাংলার গ্রামে-গঞ্জে বহুরূপীরা ছিলেন বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। শোভাযাত্রা, পালাগান, মেলার মাঠ—সব জায়গায় তাঁরা ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্র। কিন্তু সময় বদলেছে, বিনোদনের মাধ্যম বদলেছে, হারিয়ে যেতে বসেছে এই লোকশিল্পও। এখন পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে যা দু’পয়সা রোজগার হয়, তাই দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলে। তবু শিল্পের প্রতি ভালোবাসা ছাড়তে পারেননি তিনি।

বাপি ঘোষ বলেন, “এক সময় বহুরূপীদের যথেষ্ট কদর ছিল। কিন্তু এখন মানুষ মোবাইল স্ক্রিনের বিনোদনেই মেতে থাকে। আমাদের দিকে খুব কম লোকই তাকায়।” তবু তিনি এই শিল্প ছাড়তে চান না। তাঁর কথায়, “শিব রূপে রাস্তায় বেরোলে যে সম্মান পাই, তা অন্য কিছুতে পাই না। তাই যত দিন পারি, এই রূপ নিয়েই মানুষের সামনে দাঁড়াব।”

Even in the darkness of poverty the struggle of Bahurupi Bapi did not stop.

সংসার চালাতে বহুরূপীর পাশাপাশি শ্রমিকের কাজও করতে হয় বাপিকে। তারকেশ্বরের জয়কৃষ্ণ বাজারে আলুর আড়তে পরিশ্রমের কাজ করেন তিনি। দিনের বেলায় গুদামের ভারী বস্তা টানেন, আর সন্ধ্যায় মুখে রং মেখে শিল্পীর বেশ ধরে রাস্তায় নামেন। এই দ্বৈত জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হয়েছে তাঁকে।

কিন্তু প্রশ্ন একটাই—সংস্কৃতি কি শুধুই অতীতের স্মৃতি হয়ে থাকবে? বহুরূপী শিল্পীরা কি এইভাবেই হারিয়ে যাবেন? বাপির মতো শিল্পীদের লড়াই হয়তো ছোট, কিন্তু তাঁদের অদম্য অধ্যবসায় বাংলার হারিয়ে যাওয়া লোকশিল্পকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে।

একসময় এই বহুরূপীরা ছিলেন বাংলার ঐতিহ্যের অংশ। এখন তাঁরা নিছকই বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক। তবুও, যতদিন গলায় রুদ্রাক্ষ থাকবে, যতদিন হাতে থাকবে রঙের কৌটো, ততদিন বাপি ঘোষরা পথে নামবেন, মুখে হাসি রেখে শিল্পের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *