সাহিত্য জগতে ছদ্মনাম গ্রহণ করাটা সব দেশেই প্রচলিত রয়েছে। এই ছদ্মনাম গ্রহণের কাহিনীও একেক জনের একেক রকম। বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম নিয়েই লিখেছেন পিনাকীরঞ্জন পাল।
যদি বলি, চালর্স লুটউইজ ডজসন, স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লেমেন্স, উইলিয়াম সিডনি পোর্টার, মেরী অ্যান ইভান্স, প্রবোধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, কমল গুহ, অখিল নিয়োগী—এরা কারা? নামগুলো পড়ে তোমাদের অনেকেরই চোখ কপালে উঠবে হয়ত। মনে মনে ভাববে, বাব্বা: এরা আবার কারা! কিন্তু উত্তরটা বলে দিলেই মনে হবে, এম্মা: এদের সকলকেই তো চিনি। আসলে ওপরের ব্যক্তিরা হলেন লুইস ক্যারোল, মার্ক টোয়েন, ও হেনরি, জর্জ এলিয়ট, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্কর, শঙ্কু মহারাজ আর স্বপন বুড়ো। কি এবার চিনলে তো? উল্লেখিত ব্যক্তিরা হলেন সাহিত্যিক বা লেখক। ওপরের নামগুলো তাদের পিতৃদত্ত নাম আর নিচেরগুলো হল তাদের ছদ্মনাম, যে নামেই আজ তাঁরা প্রসিদ্ধি পেয়েছেন। সাহিত্য জগতে ছদ্মনাম গ্রহণ করাটা সব দেশেই প্রচলিত রয়েছে। এই ছদ্মনাম গ্রহণের কাহিনীও একেক জনের একেক রকম। আজ সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম নিয়েই তোমাদের জন্য আমরা এই লেখা।

শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই যাকে এক ডাকে চেনে সেই ‘লুইস ক্যারোল’ হল একটি ছদ্মনাম। এই ছদ্মনামের আড়ালে প্রকৃত মানুষটি হলেন চার্লস লুটউজ ডজসন। চার্লস ডজসন ‘লুইস ক্যারোল’ ছদ্মনামে লিখেছিলেন তাঁর বিশ্ববিখ্যাত রচনা ‘অ্যালিসেস অ্যাডভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড’। একবার গুজব রটল লেখক লুইস ক্যারোল মারা গেছেন। সারা ইংল্যান্ডের মানুষ হায় হায় করে উঠল। তাদের সবার প্রিয় এই লেখকের আকস্মিক মৃত্যুতে তারা শোক প্রকাশের জন্য অধীর। চার্লস ডজসনও সমবেদনা জানালেন গৃহকর্ত্রীকে যিনি মৃত্যু সংবাদটি তাঁকে শুনিয়েছিলেন। বিখ্যাত এই লেখক ছদ্মনামের আড়ালে ছিলেন বলেই গৃহকর্ত্রীও তাঁকে চিনতে পারেননি।

ছোট গল্প লেখাতে ও হেনরীর খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। তাঁর একটি সুপ্রসিদ্ধ রচনা হল ‘কাবেজেস অ্যান্ড কিংস’। এই ও হেনরীর প্রকৃত নাম হল উইলিয়াম সিডনি পোর্টার। তহবিল তছরূপের অভিযোগে একবার তার পাঁচ বছরের জেল হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্দোষ। যাইহোক, এই বন্দী জীবনের অভিজ্ঞতাই তাঁকে লেখক হিসাবে আত্মগোপনের প্রবণতার জন্ম দেয়। অনেকের অনুমান, তাঁর বন্ধু ছিলেন ও হেনরী। বন্ধুর নাম নিয়েই তিনি লেখা শুরু করেন।

‘মার্ক টোয়েন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারি আমেরিকান লেখক। তাঁর আসল নাম ছিল স্যামুয়েল লাংহর্ন ক্লেমেন্স। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম মিসৌরী-মিসিসিপি নদীর পাড়ে একদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ক্লেমেন্স সাহেব। তাঁর মাথায় ঘুরছিল একটা যুৎসই ছদ্মনামের চিন্তা। হঠাৎ সারেংদের জল মাপার শব্দে চমকে উঠে পেয়ে যান তাঁর ছদ্মনাম। আমাদের ‘এক বাঁও, দুই বাঁও’ এর মত ওদেশে সারেংরা জল মাপে ‘মার্ক ওয়ান, মার্ক টোয়েন’ করে। এখান থেকেই ক্লেমেন্স সাহেব তাঁর ছদ্মনাম রেছে নেন ‘মার্ক টোয়েন’।
‘পদ্মানদীর মাঝি’ অথবা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র স্রষ্টা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতৃদত্ত নাম ছিল প্রবোধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। একবার বন্ধুদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বন্ধুদের বক্তব্য ছিল, প্রত্যেক লেখককেই তাঁর লেখা ছাপানর জন্য তোষামোদ করতে হয়। প্রবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য ছিল, লেখা ভাল হলে তোষামোদের কোন প্রয়োজন হয় না। এই তর্কের ইতি টানতে তিনি পিতৃদত্ত নাম ত্যাগ করে. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছদ্মনামে ‘অতসী মামী’ গল্পটি লিখে বন্ধুদের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করলেন। ‘অতসী মামী’ই ছিল তাঁর লেখা প্রথম ছোট গল্প। এইভাবেই প্রবোধ হয়ে গেলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘নীল দর্পণ’ নাটকের রচয়িতা দীনবন্ধু .মিত্র—এটা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এটা জান কি দীনবন্ধু মিত্র নামটা একটি ছদ্মনাম? দীনবন্ধু মিত্র ছদ্মনামের আড়ালে আসল মানুষটি হলেন গন্ধর্বনারায়ণ মিত্র। ছোটবেলায় স্কুলের বন্ধুরা তাঁকে ডাকত ‘গন্ধ’ বলে। দুষ্টু ছেলেরা ডাকত ‘দুর্গন্ধ’ বলে। তাই শেষ পর্যন্ত গন্ধর্বনারায়ণ মনের দুঃখে ১৮৪৬ খ্রীষ্টাব্দে লঙ্ সাহেবের অবৈতনিক স্কুলে পড়বার সময় পিতৃদত্ত নামটিই পাল্টে গৈলেন দীনবন্ধু মিত্র’। অবশ্য এ ক্ষেত্রে একটা বিতর্ক রয়েছে, গন্ধর্বনারায়ণের দীনবন্ধুতে রূপান্তরকে অনেকে ছদ্মনাম গ্রহণ না বলে নামের পরিবর্তন বা রূপান্তর বলে মনে করে থাকেন। তাঁর প্রায় সব রচনাই দীনবন্ধু মিত্র নামে প্রকাশিত হয়েছিল। আর বিখ্যাত নাটক ‘নীল দর্পণ’ ঢাকা থেকে ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে প্রথমে ‘কস্যচিৎ পথিকস্য’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়।
রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি’র আসল নাম— অ্যালেক্সি ম্যাক্সিমোভিচ পেসকভ। রুশ ভাষায় গোর্কি শব্দটির অর্থ ‘তেতো’। জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখেই তিনি এই নাম নিয়ে সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ করেন।
একালের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, যাঁর সমস্ত কীর্তি এবং খ্যাতিই ছদ্মনামে তিনি হলেন সমরেশ বসু। সমরেশ বসুর পিতৃদত্ত নাম হল সুরথনাথ বসু। এ ছাড়া তার আরও দু’টি ছদ্মনাম হল –কালকূট এবং ভ্রমর। কালকূট ছদ্মনামে তিনি লিখেছিলেন ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘নির্জন সৈকতে’ প্রভৃতি রচনা।
তোমরা জানো কি বিশ্বকবি তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধিক ছদ্মনামে লেখালেখি করেছেন। কবিগুরু মোট নয়টি ছদ্মনামে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, যাঁদের মধ্যে – ‘ভানুসিংহ’ ছদ্মনামটি উল্লেখযোগ্য। অন্য ছয়টি ছদ্মনাম হল – অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর, আন্নাকালি পাকড়াশি, দিকশুন্য ভট্টাচার্য, নবীনকিশোর শর্মণ, ষষ্ঠীচরণ দেবশর্মণ, বাণীবিনোদ বন্দোপাধ্যায়, শ্রীমতী কনিষ্ঠা এবং শ্রীমতী মধ্যমা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত আরও অনেক পুরুষ সাহিত্যিক মহিলার ছদ্মনামে সাহিত্য রচনা করেছেন। যেমন প্রবাসীতে বারবার কবিতা পাঠিয়ে ছাপা না হওয়ায় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ‘নীহারিকা দেবী’ ছদ্মনামে একটি কবিতা পাঠানর সঙ্গে সঙ্গে তা ছাপা হয়। প্রখ্যাত গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তো ‘মাধামণি দেবী’ ছদ্মনামে গল্প নিয়ে রীতিমত ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ পেয়েছেন। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘অনিলা দেবী’, ‘অনুপনা দেবী’ এবং ‘অপরাজিতা দেবী’ ছদ্মনামে অনেক লিখেছেন। নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও ‘ভুবনমোহিনী দেবী’ ছদ্মনামে লিখে রবীন্দ্রনাথকে রীতিমত অবাক করে দিয়েছিলেন। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের মেয়েলি ছদ্মনাম হল ‘বৃহন্নলা বসাক’। জগদানন্দ রায় ‘শরৎকুমারী দেবী’ এবং শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় ‘নমিতা মুখোপাধ্যায়’ ছদ্মনামে কবিতা লিখেছেন।
বাংলা সাহিত্যে পুরুষদের মহিলার ছদ্মনাম গ্রহণের বহু নিদর্শন থাকলেও খুব কম মহিলাই পুরুষদের ছদ্মনামে সাহিত্য রচনা করেছেন। যেমন— সুরূপা দেবী, শাস্তা দেবী, উমারাণী রায়, হেনা হালদার, এঁরা যথাক্রমে অপ্রকাশ বন্দ্যেপাধ্যায়, মঙ্গলচন্দ্র শর্মা, অশোক গুপ্ত এবং সত্যকাম ছদ্মনানে সাহিত্য রচনা করেছেন।
ইংরেজি সাহিত্যেও একজন মহিলা পুরুষ ছদ্মনামে সাহিত্য চর্চা করে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। তিনি হলেন মেরী অ্যান ইভান্স । শ্রীমতী ইভান্স ‘জর্জ এলিয়ট ছদ্মনামে বহু উপন্যাস ও কবিতা রচনা করেছিলেন। তাঁর কয়েকটি রচনা হল ‘আদম বেদে দি মিল অন দি ফ্লস, সাইলাস মার্নার প্রভৃতি।
কিন্তু মেরি অ্যান ইভান্সের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে ব্রন্ডে বোনেরা মেয়েদের ছদ্মনামে লিখে একই সময়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। এই ব্রন্ডে তিন বোনের নাম হল- শার্লট ব্রন্ডে, এমিলি ব্রন্ডে আর অ্যান ব্রন্ডে। যদিও অনেকেরই ধারণা ব্রন্ডে বোনদের নামটিই তাঁদের আসল নাম। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। তাঁদের প্রকৃত নামগুলি হল যথাক্রমে কারর বেল, এলিস বেল এবং অ্যাক্টন বেল।
আবার জাপানের অনেক মহিলা কবি ছদ্মনামের আশ্রয় নিলেও তাঁরা কিন্তু মহিলার নামই গ্রহণ করেছেন। সাকানোয়ে জাপানের একটি জায়গার নাম। এই নামে অষ্টম শতাব্দীতে জাপানের যে মহিলা কবি প্রেমের কবিতায় উৎকর্ষতা দেখিয়েছিলেন তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ‘ও তামো’। চতুর্দশ শতাব্দীতে সংকলিত ‘হি আকু নিন্ ইসশু’ কাব্য সংকলনটিতে রয়েছে দৈনি নো সাম্মি’ নামক এক মহিলার নাম। সাম্মির আসল নাম হল ফুজিয়ারা নো কাতাকো।
এদেশের দু’জন লেখিকা আবার যৌথভাবে একটি ছদ্মনাম নিয়েছিলেন। এঁরা হলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের দুই মেয়ে সীতা দেবী ও শান্তা দেবী যৌথভাবে ‘সংযুক্তা দেবী’ ছদ্মনাম নিয়ে ‘উদ্যান লতা’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন।
ছদ্মনাম নেওয়ার ব্যাপারে রেকর্ড করেছেন সজনীকান্ত দাস। তিনি মোট সাতাশটি ছদ্মনামে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম লেখা লিখেছেন। তাঁর কয়েকটি ছদ্মনাম হল—ভাবকুমার প্রধান, গাজী আব্বাস বিটকেল, কুড়ুল রাম, কেবল রাম, গাজনদার প্রভৃতি।
ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন চারটি ছদ্মনামে। এগুলি হল—সলিলোল্লাস সাঁতরা, কালমগীর, বস্তুতান্ত্রিক চূড়ামণি এবং ত্রিবিক্রম বর্মণ।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পদাবলীকার মুকুন্দরামকে দেওয়া ‘কবিকঙ্কণ’ উপাধিটিকেই হদ্মনাম হিসাবে গ্রহণ করেছেন।
উনিশ শতকে রূপচাঁদ দাস ‘রূপচাঁদ পক্ষী’ নামে গান রচনা করতেন। পরবর্তীতে এই ছদ্মনামটিই গ্রহণ করেছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ‘রূপচাঁদ পক্ষী’ ছাড়াও শক্তি চট্টোপাধ্যায় “ফুলিঙ্গ সমাদ্দার’ আর ‘অভিনব গুপ্ত’, ছদ্মনামেও লিখেছেন।