ডিজিটাল ডেস্ক : ভারত সবসময় তার বহুত্ববাদ, বৈচিত্র্য এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য গোটা বিশ্বের কাছে অনন্য উদাহরণ। যুগ যুগ ধরে এই দেশে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায় একসঙ্গে সহাবস্থান করেছে, যা ভারতের পরিচয়ের অন্যতম মূল ভিত্তি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক এবং এর ফলে তৈরি হওয়া সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এই ঐতিহ্যকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এমন এক পটভূমিতে পুনেতে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে শুক্রবার আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তব্য নতুন করে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছে। তাঁর মন্তব্য শুধু বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে না, বরং দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির ভবিষ্যত নিয়ে দিকনির্দেশনাও দেয়।
অযোধ্যার রাম মন্দির নির্মাণ সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলেও, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মসজিদকে মন্দির বলে দাবি করার প্রবণতা নতুন এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরার শাহি ইদগা এবং রাজস্থানের আজমির শরিফের দরগা সহ একাধিক স্থানে মসজিদগুলোকে মন্দির বলে দাবি করে আদালতে মামলা করা হয়েছে। এইসব মামলায় আদালতের হস্তক্ষেপ ও জরিপের নির্দেশ দেশজুড়ে নতুন করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তব্য প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে, এই ধরনের বিতর্ক গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি শুধু হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে আঘাত করছে। তাঁর মতে, অযোধ্যার রাম মন্দির নির্মাণের পেছনে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দিক ছিল, যা গোটা হিন্দু সমাজের বিশ্বাসের প্রতীক। কিন্তু বর্তমানে মসজিদকে মন্দির বলে দাবি করার প্রবণতা মূলত স্বার্থান্বেষী উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
মোহন ভাগবতের এই পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, এই বিতর্কগুলো ধর্মীয় অনুভূতির চেয়ে বেশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। কিছু ব্যক্তি নিজেদের স্বঘোষিত “হিন্দু নেতা” হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে এই ইস্যুগুলিকে ব্যবহার করছেন, যা সমাজে বিভাজন বাড়াচ্ছে। এছাড়া, তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, ভারতের শাসন ব্যবস্থা সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয় এবং কোনও সম্প্রদায় বা ব্যক্তির ইচ্ছামতো নয়। এ ধরনের বিতর্ক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বদলে বিভেদের বীজ বুনছে, যা ভারতকে “বিশ্বগুরু” হিসাবে প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করছে।
মোহন ভাগবতের বক্তব্যে একটি সুস্পষ্ট বার্তা উঠে এসেছে—ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের ঐতিহ্যই ভারতের আসল পরিচয়। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের উচিত সংবিধান মেনে চলা এবং অযথা বিতর্ক থেকে দূরে থাকা। ভারতের ভবিষ্যৎ ধর্মীয় ঐক্য ও সম্প্রীতির ওপর নির্ভরশীল, এবং এটিকে ক্ষুণ্ন করা হলে তা শুধুমাত্র দেশকেই দুর্বল করবে।
মোহন ভাগবত তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, “ভারত সংবিধান অনুযায়ী চলে। আধিপত্যের দিন শেষ। কেউ পেশী শক্তি বা ধর্মীয় গোঁড়ামির ভিত্তিতে আধিপত্য কায়েম করতে পারবে না।” এই বক্তব্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে তিনি স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, দেশ শাসন এবং সামাজিক সমতা সংবিধানের দেখানো পথেই চলবে।
তিনি আরও বলেন, “দেশে কোনো সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু ধারণা থাকা উচিত নয়। প্রত্যেক নাগরিকই সমান।” এই বক্তব্য সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
মোহন ভাগবতের বক্তব্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের ঐতিহ্য নিয়ে যে উদাহরণ উঠে এসেছে, তা ভারতীয় সমাজের বহুত্ববাদী চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে। তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের বড়দিন উদযাপনের উদাহরণ টেনে বলেন, “আমরা হিন্দু, তাই আমরা সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ঐতিহ্যে বিশ্বাস করি।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, হিন্দু ধর্মের মৌলিক বৈশিষ্ট্যই হলো সহিষ্ণুতা এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।
রামকৃষ্ণ মিশন বরাবরই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের মডেল হিসেবে কাজ করেছে, যেখানে ঈশ্বরের একাধিক পথের ধারণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভাগবতের এই বক্তব্যে ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধার যে বার্তা উঠে এসেছে, তা কেবল দেশের ভেতরেই নয়, বিশ্বের কাছেও ভারতের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ।
তাঁর মতে, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই ভারতের প্রধান শক্তি। এটি সেই শক্তি, যা ভারতকে বহিরাগত আক্রমণের মধ্যেও টিকিয়ে রেখেছে এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে। কিন্তু এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে, প্রতিটি সম্প্রদায়ের উচিত একে অপরের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সম্মান করা।
ভাগবতের বক্তব্যে অন্য একটি দিকও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আসলে বোঝাতে চেয়েছেন, হিন্দু ধর্ম শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতা বা উপাসনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি এমন একটি জীবন দর্শন যা অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির জন্যও জায়গা তৈরি করে। তাঁর এই বক্তব্য ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তবে, এই মন্তব্যের রাজনৈতিক দিকও অস্বীকার করা যায় না। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি একদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি সহিষ্ণু চিত্র তুলে ধরছেন, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমানোর প্রয়াসও করছেন। বর্তমান সময়ে মন্দির-মসজিদ বিতর্কের আবহে এই ধরনের বক্তব্য শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এটি কেবল একতার আহ্বানই নয়, বরং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টাও বটে।
মোহন ভাগবত ব্রিটিশ শাসনের সময় হিন্দু-মুসলিম সংঘাতকে এই সমস্যার মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ব্রিটিশ শাসকেরা Divide and Rule নীতি প্রয়োগ করে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল, যার ফলশ্রুতিতে ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজন ঘটেছে।
মোহন ভাগবতের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা করার দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের। ভারতকে বিশ্বগুরু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ পরিহার করতে হবে। ভারতীয় সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে সমানাধিকার দিয়েছে এবং সেটাই দেশের শাসনের ভিত্তি হওয়া উচিত।
তবে, এখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। মসজিদ- মন্দির ইস্যুতে আরএসএসের ভূমিকা কী? সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, রাম মন্দির নির্মাণের পর সংঘ ঘোষণা করেছিল যে তারা আর মন্দির-মসজিদ বিতর্কে থাকবে না। কিন্তু বাস্তবে কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কার্যকলাপ সেই অবস্থানের সঙ্গে মিলছে না। এ নিয়ে সংঘের অভ্যন্তরে কী ধরনের আলোচনা হয়, সেটি স্পষ্ট নয়।
মোহন ভাগবতের বক্তব্য বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সম্প্রীতির গুরুত্ব পুনরায় মনে করিয়ে দিয়েছে। তাঁর বার্তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এটি কেবল বক্তব্য হিসেবে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। সংবিধানের শাসন এবং সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের মূল্যবোধ মেনে চলাই ভারতের জন্য একমাত্র পথ। ভারতের ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে বিশ্বগুরু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দেশবাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।