পিনাকী রঞ্জন পাল
ছোট্ট বন্ধুরা, আজ তোমাদের শোনাব বাংলার বিশ্ববিখ্যাত মসলিন বস্ত্র শিল্পের কথা। তোমরা হয়ত অনেকেই শুনেছ মসলিন কাপড়ের নাম। এ কাপড়ের সূক্ষ্মতা এতটাই ছিল যে ২০ হাত লম্বা ২ হাত চওড়া একটা মসলিনকে আংটির ভেতর দিয়ে অনায়াসে টেনে বের করা যেত। পারস্যের রাজদূত মহম্মদ আলি বেগ পারস্যের সম্রাটের জন্য ৬০ হাত একখানা কাপড় ছোট্ট একটা নারকেল মালায় পুরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এসব শুনে তোমরা হয়ত অবাক হচ্ছ! ভাবছ এমন কখনও হয় নাকি ? কিন্তু বন্ধুরা অবাক হবার কিছুই নেই। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ১৭৫ হাত লম্বা একটি মসলিন কাপড়ের ওজন হয়েছিল চার তোলা।
বাংলাদেশের গর্ব ছিল এই মসলিন শিল্প। এ কাপড় ঢাকায় তৈরি হত বলে একে ঢাকাই মসলিনও বলা হত। মসলিন শিল্প শুরু হয় প্রায় তিন হাজার বছর আগে। খ্রিস্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেলেও মসলিনের উল্লেখ আছে। বহু প্রাচীনকাল থেকেই স্থলপথে আলেকজেন্দ্রিয়া হয়ে মসলিন রোম, গ্রিস প্রভৃতি দেশে চালান যেত বাংলাদেশ থেকে। তুর্কি সুলতানেরা এই মসলিন ব্যবহার করতেন। আর তুরস্কের রাজধানী ছিল মোসলনগর। এই মোসলনগর থেকেই কাপড়ের নামটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তাই অনেকের মতে এই মোসল থেকে কাপড়ের নাম হয়েছে মসলিন।
মসলিন কাপড় তৈরি হত কার্পাস তুলোর সুতো দিয়েই, যা দিয়ে আমাদের সাধারণ সুতি কাপড় তৈরি হয়। তবে তুলো হলেও এ এক বিশেষ ধরনের তুলো, যার নাম কোটি বা শিরক তুলো। ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ থেকে উত্তর দিকে মাত্র ৬৫ মাইল জায়গা জুড়ে এই তুলোর চাষ হত। তাঁত চলত ওই জেলারই সোনারগাঁও, নোয়াগাঁ, মুড়াপড়া, কাপাসিয়া প্রভৃতি স্থানে। এছাড়া ময়মনসিংয়ের বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ি প্রভৃতি স্থানেও মসলিন তৈরি হত। ঢাকাই মসলিনের অর্ধেক আসত কিশোরগঞ্জ থেকে। পলাশির যুদ্ধের আগে পর্যন্ত ঢাকায় প্রতি বছর প্রায় ৩০ লক্ষ টাকার মসলিন কাপড় বিক্রি হত। রাজা বাদশা বা ধনি লোকেরা মসলিনের তখনকার দিনেই ২০০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। এই ধরনের এক একখানা মসলিন কাপড় তৈরি করতে একজন শিল্পীর ছ’মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগত। ভাল মসলিন তৈরির কারিগরদের নবাব বাদশারা নিষ্কর জমি দান করা ছাড়াও নগদ অর্থ পুরস্কার দিতেন।
মিহি মোলায়েম সৌখিন মসলিন অনেক ধরনের ছিল। যেমন –’ঝুনা মসলিনের সুতো ছিল মাকড়সার জালের মত মিহি। পাশ্চাত্যের লোকেরা বলতেন, এ কাপড় পরীদের তৈরি, মানুষের পক্ষে এ কাপড় কখনও তৈরি করা সম্ভব নয়। সবনম বা সান্ধ্য শিশির : এই মসলিন কাপড় ঘাসের ওপর ফেলে দিলে দেখা যেত না। নবাব আলিবর্দি খাঁ পরীক্ষার জন্য এই মসলিন একবার ঘাসের ওপর মেলে দিয়েছিলেন। একটা গরু এসে সেখানকার ঘাস খেতে এসে টের না পেয়ে কাপড় সহ ঘাস খেয়ে ফেলেছিল। ইউরোপীয় কবিরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘বায়ুর জাল’।
‘আবরোয়ান’ মসলিন কাপড় জলের মধ্যে ফেললে দেখাই যেত না। একবার বাদশা ঔরঙ্গজেবের মেয়ে বেগম জেবউন্নিসা পিতার সঙ্গে দেখা করতে এসে ভীষণ বকুনি খেলেন। পিতা ভেবেছিলেন মেয়ে কাপড় পরেই আসেনি। জেবউন্নিসা বললেন, ‘সেকি, বাবা, বিশ হাত কাপড় সাত ফের করে আমি পরে এসেছি।’ বুঝতেই পারছ আসলে জেবউন্নিসা পরে এসেছিলেন আবরোয়ান মসলিনের কাপড়।
এছাড়াও ছিল ‘সরকার আলি’ মসলিন নবাব বাদশা এগুলো ব্যবহার করতেন। ‘সরবন্ধ’ আর ‘সরবর্তি’ মসলিন দিয়ে পাগড়ি করা হত। ‘কুমীস’ মসলিন দিয়ে নবাব বাদশারা কুর্তা বা জামা তৈরি করতেন। ‘জামদানি মসলিন’ আবার শুধুমাত্র নবাব বাদশাদের জন্যই তৈরি হত। আর এক ধরনের মসলিনের নাম ছিল ‘মলমল খাস’ নবাব জাফর আলি খাঁ প্রতি বছর ৫০০টি করে মলমল খাস মসলিনের কাপড় বাদশা ঔরঙ্গজেবকে পাঠাতেন। শুধু সাদা প্লেন মসলিনই নয় পাওয়া যেত বিভিন্ন ধরনের ডোরাকাটা এবং ফুলকাটা বুটিদার মসলিন কাপড়ও।
এবার জানাব মসলিনের সুতো কাটা সম্পর্কে। কার্পাস গাছে ফেটে গেলে তা দিয়ে মসলিনের সুতো কাটা যেত না। বীজের গায়ে তুলো লেগে থাকতে থাকতেই গাছ থেকে সেগুলি তুলে নেওয়া হত। এই তুলো ধুনা, পাট করা এবং তা থেকে সুতো তৈরিতে বিশেষ সতর্কতা নেওয়া হত। ১৫ থেকে ২০ বছরের স্থির, ধর্মবর্তী মেয়েরা আবহাওয়া ভাল থাকলে সকালে স্নান করে ঠাণ্ডা মাথায় সুতো কাটা শুরু করত। আবহাওয়া খারাপ বুঝলেই সুতো কাটা বন্ধ করে দেওয়া হত।