আইসক্রিমের (Icecream) নামেই জিভে আসে জল। আর এই গরমে আইসক্রিম কে না চায় ? কিন্তু এই জিভে জল আনা, প্রাণ শীতল করা সুস্বাদু খাবারটির সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি ? ক’জন জানি বিশ্বে প্রথম এর ‘রেসিপি’ (Recipe) তৈরি করেছিলেন রোমান সেনাপতি ম্যাক্সিমস অথবা রোমান সম্রাট নীরো কিংবা গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার ছিলেন ভীষণ আইসক্রিমপ্রেমী। আইসক্রিম নিয়েই আজ লিখেছেন- পিনাকী রঞ্জন পাল।

হাজার হাজার বছর আগে কোনো এক দেশে এক বুড়ো ভুল করে দুধের কাপ ঘরের বাইরে রেখে দিয়েছিল। সকালে উঠে যখন সে দেখলো যে কাপে থাকা দুধ জমে বরফে পরিণত হয়েছে, তখন সে ঐ জমে যাওয়া দুধকে অবশ্যই চেখে দেখেছিল। সেটা চাখতেই এক অসাধারণ স্বাদ, তার জিভে লেগেছিল। নাম না জানা সেই মানুষটি এভাবেই হয়ে উঠেছিল আইসক্রিমের আবিষ্কারক।

‘বাইবেল’ (Bibel)- এর কয়েক জায়গায় দুধ (Milk) আর মধুর (Hunny) উল্লেখ রয়েছে। অনেকে মনে করেন এটাও এক ধরনের আইসক্রিম। অন্যদিকে এশিয়াতে প্রায় তিন হাজার বছর আগে চীনের বাসিন্দারা হিমপাত হওয়ার পরে বরফ তুলে আনতেন আর তাতে ফলের রস ঢেলে পান করতেন। হয়তো তারা তাতে দুধও ঢালতেন। এগুলোকে অবশ্য ঠিক আইসক্রিম বলা যায় না, তবে এসবের সঙ্গে আইসক্রিমের সাদৃশ্য অবশ্যই কিছুটা লক্ষ্যণীয়।

গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার আইসক্রিম খেতে ভীষণ ভালোবাসতেন। আইসক্রিম বানাবার জন্য ক্রীতদাসদের এক দল যেত পাহাড়ের চূড়ায় বরফ আনতে। বরফ খুব দ্রুত নিচে পৌঁছানোর জন্য কিছুদূর পরপর তারা লাইন করে দাঁড়াতো যাতে কাউকেই এক মাইল বা আধা মাইলের বোশ দৌড়াতে না হয় আর ক্লান্ত হয়ে না পড়ে। ঠিক আজকালকার ‘রিলে দৌড়ে’র মত, এক দৌড়বীর অন্য দৌড়বীরকে নিজের ‘ব্যাটন’ দিয়ে দেয়। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা রাঁধুনিরা আগে থেকেই দুধ, মধু আর ফলের রসের সঙ্গে অন্য কয়েক ধরনের সুস্বাদু, পুষ্টিকর খাদ্য তৈরি করে রাখত, আর বরফ এসে পৌঁছাতেই সেগুলি জমানো হত বরফ দিয়ে। এইভাবেই তখন এতো চড়াই উত্রাই পেরিয়ে তৈরি হতো বরফ।

প্রাচীন মিশরের রাজারাও আইসক্রিমপ্রেমী ছিলেন, তবে তাঁরা কি উপায়ে আইসক্রিম বানাতেন সেটা জানা যায়নি। রোমান সম্রাট নীরো’ও আইসক্রিম খেতে ভালবাসতেন এবং তিনিও আলেকজান্ডারের পদ্ধতিতে আইসক্রিম তৈরি করাতেন।
বিশ্বের প্রথম আইসক্রিমের ‘রেসেপি’ তৈরি করেছিলেন রোমান সেনাপতি ম্যাক্সিমস। ম্যাক্সিমস আইসক্রিম ভীষণ ভালোবাসতেন আর এইজন্য লোকেরা তাকে আড়ালে ‘পেটুক’ বলেও ডাকত।
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গেই ইউরোপীয়নরা আইসক্রিমের কথা ভুলে যান। চীনারা কিন্তু তখনো আইসক্রিম উপভোগ করছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইটালীর পর্যটক মার্কোপোলো যাত্রাপথে চীনে গিয়ে পৌঁছান। চীনের বাসিন্দাদের কাছ থেকে তিনি আইসক্রিমের রেসিপি নিয়ে ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফেরেন। এইভাবেই আইসক্রিম আবার ইউরোপে ফিরে আসে।
১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে ইটালীর রাজকুমারী ক্যাথরিথ ফ্রান্সের রাজকুমার দ্বিতীয় হেনরির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সঙ্গে করে আনেন আইসক্রিম তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম। এইভাবে ইটালী থেকে আইসক্রিম পৌঁছায় ফ্রান্সে।
১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে আবার ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ হেনরীর কন্যা ইংল্যান্ডের রাজকুমার প্রথম চার্লসকে বিবাহ করে। আর এভাবেই আইসক্রিম ইংল্যান্ডে পদার্পণ করে। প্রথম চার্লস ভীষণ ভালোবাসতেন আইসক্রিম খেতে এবং তিনি রাঁধুনিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে সাধারণ নাগরিক যেন আইসক্রিমের রেসিপি না পায়।
এরই মধ্যে আইসক্রিম তৈরির পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। ইটালীর এক ব্যক্তি ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বরফ তৈরি করার একটি ছোট্ট মেশিন তৈরি করেন। তিনি লেমোনেড বিক্রি করতেন। মেশিন তৈরির পর তার সাহায্যে লেমোনেডকে বরফ বানিয়ে বিক্রি শুরু করেন। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে এক আমেরিকান মহিলা বিজ্ঞানী ন্যান্সী জনসন আরো উন্নতমানের মেশিন তৈরি করেন। এই মেশিনের সবচেয়ে বড় ফায়দা হলো, আইসক্রিম তৈরি করতে আর মানুষকে প্রকৃতি-সৃষ্ট বরফের ওপর নির্ভর করতে হলো না।
১৭০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আইসক্রিম আমেরিকা আর ইউরোপে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন এতো ভালোবাসতেন যে একবার গরমকালে মাত্র দু’মাসে তিনি দু’শো ডলার মূল্যের আইসক্রিম খেয়েছিলেন।
১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার বাল্টিমোরে জেকব ফাস্যাল বিশ্বের প্রথম আইসক্রিম তৈরির কোম্পানি স্থাপন করেন। জেকব তার কোম্পানিতে এত আইসক্রিম তৈরি করেছিলেন যে প্রায় ১ লিটার আইসক্রিম ২৫ সেন্ট দামে বিক্রি করতে হয়েছিল।
এইভাবেই শুরু হয়েছিল আইসক্রিমের জয়যাত্রা। এখনতো নানা রঙের, নানা স্বাদের আইসক্রিম তৈরি হয়ে থাকে। গ্রীকবীর আলেকজান্ডার কি কখনো ভেবেছিলেন যে এতো কষ্ট করে তিনি যা তৈরি করাচ্ছেন তা একদিন এতই সম্ভা আর সাধারণ হয়ে যাবে যে সাধারণ নাগরিকরাও তা খেতে পারবে ? কিংবা প্রথম চার্লস যৈ রেসিপি গোপন রাখার চেষ্টা করেছিলেন তা একদিন সকলেই জেনে যাবে এবং তারা সহজেই বাড়িতে রেফ্রিজারেটরের সাহায্যে বানাতে পারবে?