পিনাকী রঞ্জন পাল : সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে আইসিসির টি-টোয়েন্টি ব্যাটারদের র্যাঙ্কিংয়ে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছেন তিলক ভার্মা। ভারতীয় এই টপ অর্ডার ব্যাটার গত সপ্তাহে ৭২ নম্বরে ছিলেন। মাত্র এক সপ্তাহে ৬৯ ধাপ এগিয়েছেন ২২ বছর বয়সী তিলক। আজ শোনাবো এই তিলকের কিছু কথা।
প্রতিভার জ্বালানি আর আত্মবিশ্বাসের আলো
একটি ছোট্ট ঘর। হায়দরাবাদের এক প্রান্তে বসবাসকারী এক ইলেকট্রিশিয়ানের পরিবার। চারপাশে সীমিত সুযোগ-সুবিধা। আর তার মধ্যেই বেড়ে ওঠা এক কিশোর, যার চোখে ছিল স্বপ্নের আলো। সেই স্বপ্ন ক্রিকেটের মাঠে দেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরার। ছোটবেলা থেকেই কেবলমাত্র প্রতিভা, অধ্যবসায় এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির জ্বালানিতে এগিয়ে গিয়েছেন তিলক ভার্মা। তার জীবন কাহিনী এক প্রমাণ যে সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও প্রতিভার বিকাশ সম্ভব, যদি থাকে ইচ্ছাশক্তি এবং পরিশ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা।
স্বপ্নের পথে প্রথম পদক্ষেপ
তিলকের শৈশব একেবারেই সহজ ছিল না। ইলেকট্রিশিয়ান বাবার আয়ে কোনোভাবে সংসার চলত। ক্রিকেট খেলার ব্যাট বা প্যাড কেনার মতো আর্থিক সামর্থ্য পরিবারের ছিল না। কিন্তু ছোটবেলার কোচ সেলিম বায়াশ তিলকের মধ্যে এক বিশেষ সম্ভাবনা দেখেছিলেন। টেনিস বলের ক্রিকেটে ব্যাট চালানোর দক্ষতা দেখে তিনি তিলককে লেগালা ক্রিকেট একাডেমিতে নিয়ে যান।
সেখানে প্রতিদিন তিলককে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে যাতায়াত করতে হতো। কিন্তু তিলক জানতেন, প্রতিটি যাত্রা তাকে স্বপ্নের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। কোচ বায়াশ তার সমস্ত খরচ বহন করতেন এবং শুধু ক্রিকেটে মনোযোগ দিতে বলতেন। এই আত্মত্যাগ আর পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল এক অসাধারণ যাত্রার।
আইপিএলে তিলকের জ্বলজ্বলে সূচনা
২০২২ সালের আইপিএল নিলাম। তিলকের বেস প্রাইস ছিল মাত্র ২০ লাখ। কিন্তু শচিন টেন্ডুলকারের সুপারিশে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় তাকে দলে নেয়। প্রথম সিজনে, যখন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক, তখনও তিলক নিজের প্রতিভা দেখাতে সক্ষম হন। দল যখন সংগ্রামে ছিল, তিলক ছিলেন দলের অন্যতম উজ্জ্বল মুখ।
এক বছর পর আবার আইপিএলে তিনি দুর্দান্ত পারফর্ম করেন। ব্যাট হাতে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পা রাখার সুযোগ তৈরি করেন। ২০২৩ সালের শেষে জাতীয় দলে তার অন্তর্ভুক্তি নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ‘প্রতিভার বিস্ফোরণ’
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে তিলকের প্রাপ্ত সুযোগ যেন তার প্রতিভার আসল পরীক্ষা। প্রথম দুটি ম্যাচে ব্যর্থ হওয়ার পর তৃতীয় এবং চতুর্থ ম্যাচে তিনি এমন ইনিংস খেলেন যা তার নাম ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে দেয়। ৫৬ বলে ১০৭ এবং ৪৭ বলে ১২০—দুটি বিস্ফোরক ইনিংস তাকে আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে ৭২ নম্বর থেকে সরাসরি তৃতীয় স্থানে নিয়ে আসে।
এই অর্জন শুধু তিলকের নয়, বরং তার মতো সকল তরুণের জন্য প্রমাণ যে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারলে স্বপ্নও বাস্তব হয়।
মানসিক দৃঢ়তা ও ক্রিকেটে পারদর্শিতা
তিলক শুধু ব্যাটসম্যান নন; তিনি ক্রিকেটে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার ধরণ বদলানোর ক্ষমতা, অফ স্পিন বোলিং এবং মাঠে থাকা দৃঢ় মানসিকতাই তাকে আলাদা করে তুলেছে। তিনি জানেন কখন গিয়ার বদলাতে হবে, কখন প্রতিপক্ষের উপর চড়াও হতে হবে। তার মতো ক্রিকেটারের ভবিষ্যৎ যে কত উজ্জ্বল, তা অনুমান করা কঠিন নয়।
সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা
তিলকের গল্প শুধু একজন ক্রিকেটারের সফল হওয়ার কাহিনী নয়। এটি এমন একজন তরুণের গল্প, যিনি তার পায়ের নিচে শক্ত জমি তৈরি করেছেন। তার সংগ্রাম, সাফল্য এবং লড়াই প্রমাণ করে যে সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও নিজেকে আলোকিত করা সম্ভব।
যে পরিবার একসময় আর্থিক সংকটে ছিল, আজ সেই পরিবার গর্বিত। আর তিলক শুধু তার পরিবার নয়, গোটা দেশের অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল
২২ বছরের তিলক ভার্মা তার জীবনের শুরুতেই যা অর্জন করেছেন, তা অনেকের জন্য কল্পনারও বাইরে। কিন্তু তিনি জানেন, এই যাত্রা মাত্র শুরু। সামনে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ, আরও বড় মঞ্চ। তিলক যেমন তার কোচ, পরিবার এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন, তেমনই এই বিশ্বাসের প্রতিদান দিতে তিনি প্রতিদিন নিজেকে আরও উন্নত করছেন।
তিলকের কাহিনী আমাদের শেখায় যে জীবন কখনোই সহজ নয়, কিন্তু পরিশ্রম, ধৈর্য এবং সঠিক গাইডেন্স থাকলে যেকোনো শৃঙ্গ জয় করা সম্ভব। তিলক ভার্মা আজ একজন তারকা, কিন্তু তার গল্প সাধারণ মানুষের। আর তাই, তার এই যাত্রা আমাদের সকলের জন্য এক চিরন্তন অনুপ্রেরণা।