Cricket : উরভিল প্যাটেলের দুরন্ত প্রত্যাবর্তন – উপেক্ষার জবাব ব্যাট হাতে

পিনাকী রঞ্জন পাল : ক্রিকেট ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে উপেক্ষার শিকার খেলোয়াড়রা নিজেদের প্রতিভার জোরে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। এমনই এক অধ্যায়ের নায়ক হয়ে উঠেছেন গুজরাটের তরুণ উইকেটে কিপার ব্যাটসম্যান উরভিল প্যাটেল, পুরো নাম উরভিল মুকেশ প্যাটেল। যে খেলোয়াড়কে একদিন আগেও আইপিএল নিলামে কেউ কিনতে আগ্রহ দেখায়নি, যার নাম ছিল unsold এর তালিকায়। সেই খেলোয়াড়ই মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ভারতের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ে গোটা ক্রিকেট মহলে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন।

রেকর্ড গড়া ইনিংস

বুধবার সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফির মঞ্চে ত্রিপুরার বিপক্ষে ২৮ বলে সেঞ্চুরি করে উরভিল প্যাটেল নতুন ইতিহাস লিখেছেন। ভেঙে দিয়েছেন আইপিএলের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় ঋষভ পন্থ এর রেকর্ড। উরভিলের এই ইনিংসে ছিল ৭টি চারের পাশাপাশি ১২টি বিশাল ছক্কা। স্ট্রাইক রেট ছিল ৩২২.৮৬। ত্রিপুরার বোলারদের ওপর যেন তান্ডব চালান তিনি। মিড উইকেটের উপর দিয়ে একের পর এক ছক্কা মারার সময় তার চোখে-মুখে ফুটে উঠছিল একটাই ভাবনা— উপেক্ষার জবাব। এমন বিধ্বংসী ইনিংস দেখার পর ক্রিকেট বিশ্ব উরভিলকে নতুন করে চিনল। উরভিলের এই শতরান তার ভেতরে জমে থাকা রাগ, অভিমান, এবং প্রত্যয়কে বাইশ গজে তুলে ধরেছে। এই ইনিংসটি শুধুই রেকর্ড নয়; এটি ছিল তার ক্রিকেট জীবনের পুনর্জাগরণের মতো।

উরভিলের ক্রিকেট যাত্রা

উরভিলের ক্রিকেট যাত্রা শুরু হয়েছিল গুজরাটের মেহসানার কাহিপুর গ্রামে। জন্ম ১৯৯৮ সালের ১৭ অক্টোবর। ছোটবেলায় গ্রামের মাঠে ব্যাট হাতে শখের ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। পরে বরোদার হয়ে ২০১৭-১৮ সালের জোনাল টি-টোয়েন্টি লিগে পেশাদার ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার।

উরভিলের ক্রিকেট দক্ষতা শুরু থেকেই চোখে পড়ার মতো ছিল। ২০২৩ সালের বিজয় হাজারে ট্রফিতে মাত্র ৪১ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। সেই পারফরম্যান্সের পরও তাকে আইপিএলে ব্রাত্য থাকতে হয়। কিন্তু তার প্রতিভার চর্চা থেমে যায়নি।

জেদ, পরিশ্রম আর সফলতার পথচলা

উরভিলের সাফল্যের পেছনে রয়েছে তার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং জেদ। যখন তাকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি, তিনি নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন। তিনি জানতেন, একদিন বাইশ গজে তার প্রতিভার ঝলক সবাইকে মুগ্ধ করবে। এবং তার সেঞ্চুরির পরিপ্রেক্ষিতে যে কথাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো, প্রত্যাখ্যান কখনোই শেষ নয়, বরং নতুন শুরুর জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।

উপেক্ষা এবং জেদ

এবার আইপিএলের মেগা নিলামে উরভিলের নাম ছিল তালিকায়। ৩০ লক্ষ টাকার বেস রেটে নাম দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু কোনো দলই তাকে কেনার আগ্রহ দেখায়নি। এমনকি গত মরসুমে গুজরাট টাইটান্স দলে তাকে রাখলেও একটিও ম্যাচ খেলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তবে এই সমস্ত উপেক্ষার জবাব তিনি দিয়েছেন দারুণ শৈল্পিক ভঙ্গিতে। ব্যাট হাতে তিনি যেন প্রমাণ করেছেন, প্রতিভা কখনো চাপা থাকে না। সময়মতো তা নিজের জায়গা ঠিকই তৈরি করে নেয়।

পন্থের রেকর্ড ভাঙা এবং তার তাৎপর্য

২০১৮ সালে ঋষভ পন্থ সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতেই ৩২ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন, যা এতদিন ধরে ভারতীয়দের মধ্যে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড ছিল। এবার সেই রেকর্ড ভেঙে দিলেন উরভিল। পন্থ, যিনি বর্তমানে আইপিএলে সবচেয়ে দামি ক্রিকেটারদের একজন, তার সঙ্গে তুলনা হওয়া থেকেই বোঝা যায় উরভিলের ইনিংস কতটা অসাধারণ। বিশ্ব টি২০ ক্রিকেটে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড রয়েছে এস্তোনিয়ার সাহিল চৌহানের। যিনি ২৭ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন সাইপ্রাসের বিরুদ্ধে। যদিও বুধবার একটুর জন্য সেই রেকর্ড অক্ষুন্ন থেকে যায়।

এই রেকর্ড ভাঙার মানে শুধু পরিসংখ্যান নয়; এটি প্রমাণ করে, কোনো খেলোয়াড়ের মূল্য কেবল তার সাফল্যের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হওয়া উচিত, গতকাল তাকে দলে নেওয়া হয়নি বলে নয়। উরভিল যেন সেই বার্তাই দিলেন, “তোমরা আমাকে খেলার সুযোগ না দিয়ে উপেক্ষা করলেও আমি আমার খেলা দিয়ে প্রমাণ করব, আমি যোগ্য।”

প্রতিভার বিস্ফোরণ

উরভিলের এই পারফরম্যান্স অনেক প্রশ্ন তোলে। তিনি কি আগে সুযোগ পেলে এমন পারফরম্যান্স করতে পারতেন না? ক্রিকেট নির্বাচকরা কি তাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেননি? এমন একটি ইনিংস ভবিষ্যতের জন্য তার প্রতি কীভাবে ক্রিকেট মহলের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে?

উরভিলের এই ইনিংস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিভার বিকাশের জন্য সঠিক সুযোগ এবং মনোবল ধরে রাখার প্রয়োজন। কেউ যদি নিজের লক্ষ্য নিয়ে সচেতন থাকে এবং কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যায়, তাহলে সাফল্য আসবেই।

ভবিষ্যতের পথ

উরভিল প্যাটেলের এই ইনিংস তাকে ক্রিকেট দুনিয়ায় পরিচিতি দিয়েছে, তবে সামনে তার পথ এখনও দীর্ঘ। একটি রেকর্ড গড়া সহজ, কিন্তু ধারাবাহিক পারফরম্যান্স ধরে রাখাই সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ। আইপিএল দলগুলো তার প্রতি আগ্রহ দেখাবে, জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য তার প্রতিভাকে আরও প্রমাণ করতে হবে।

অনুপ্রেরণার উৎস

উরভিল প্যাটেলের এই গল্প শুধু ক্রিকেট নয়, বরং জীবনেও অনুপ্রেরণা দেয়। ব্যর্থতার পরেও কীভাবে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়, তা তিনি হাতে-নাতে দেখিয়েছেন। এই ইনিংস তরুণ খেলোয়াড়দের শেখাবে, প্রতিভার প্রতি বিশ্বাস এবং কঠোর পরিশ্রমই সাফল্যের আসল চাবিকাঠি।

উপেক্ষার জবাবে উরভিল যেমন ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছেন, তেমনই তিনি দেখিয়েছেন, জীবন আপনাকে একবার সুযোগ দিলেই তা ধরে নেওয়ার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। তার এই লড়াই সত্যিই কুর্নিশ করার মতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *