এ কেমন উপহার (কল্পবিজ্ঞানের গল্প)

নিজেদের বংশধরদের জন্য এ কেমন উপহার রেখে গেছে মানুষ! মানুষের প্রতি নিজের স্নেহ বিলিয়ে দেওয়া প্রকৃতি আজ ভয়ানক আর নির্মম মৃত্যুর রূপ ধারণ করেছে।

মূল লেখিকা কল্পনা কুলশেষ্ঠ
হিন্দি থেকে অনুবাদ : পিনাকীরঞ্জন পাল

বিংশ শতাব্দীর উত্তরার্ধের একটি হিমশীতল আর বিষণ্ণ বিকেল। প্রবীণ বিজ্ঞানী প্রফেসর কামীন তাঁর গবেষণাগারে বসে ক্ষুদ্রকায় গুঞ্জনকান্তের সঙ্গে একটি গম্ভীর বিষয়ে আলোচনা করছিলেন।

—আপনি আর একবার পুনরায় ভেবে দেখুন যে, মানসিক দিক দিয়ে কি আপনি এই কাজের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত ? যদি না থাকেন তবে….., প্রফেসর কামীন গুঞ্জনকান্তের জবাব স্পষ্ট করে জানতে চান।

—আমি ক্যান্সারের মত প্রাণঘাতী অসুখে আক্রান্ত, প্রফেসর। এর ওষুধের খোঁজ করতে করতে আজ মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখন অকাল মৃত্যুই আমার নিয়তি। কিন্তু আমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই পৃথিবীতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাঁচতে চাই। এই পাখিদের কলরব, উন্মুক্ত নীলাকাশ, আর সবুজে ভরা মনোরম উপত্যকাকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতেও কষ্ট হয়। বলতে বলতে ভাবাবেশে গুঞ্জনকান্তের স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।

—একশো বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা রাজকন্যার গল্প তো আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন? প্রফেসর কামীন হাসিমুখে জানতে চান।

– আপনি কি বলতে চাইছেন? হঠাৎ বিষয় পরিবর্তন হওয়ায় গুঞ্জনকান্ত কিছুটা হকচকিয়ে যান।

—এক বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আপনার মনো-শারীরিক কাজকর্মের গতিকে অত্যন্ত কমিয়ে আমি আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব। আর যেদিন সময়ের মহানায়ক বিজ্ঞান ক্যান্সারের ওষুধ খুঁজে পাবে, তখন বিজ্ঞানের জাদুদণ্ড আপনার মাথায় ছুঁইয়ে আপনাকে সেই রাজকন্যার মত রোগমুক্ত করে অসীম নিদ্রা থেকে জাগ্রত করবে। প্রফেসর কামীন বলেন।

একথা শুনে প্রায় জোর করেই হেসে ওঠেন গুঞ্জনকান্ত। এমনটা কি হওয়া সত্যিই সম্ভব, প্রফেসর কামীন ?

–কেন হবে না? অনেক জীব-জন্তুর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে এই ব্যবস্থা থাকে যে, তারা পরিবেশের প্রতিকূল অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের শারীরিক কাজকর্মের গতি কমিয়ে শীতনিদ্রা অথবা গ্রীষ্মনিদ্রাতে চলে যেতে পারে। পরিবেশ অনুকূল হলে পুনরায় তারা জেগে ওঠে। প্রফেসর কামীন গুঞ্জনকান্তের অশান্ত মনকে বোঝাবার চেষ্টা করেন।

—আমি বুঝতে পেরেছি, প্রফেসর ! তাই এই সুন্দর পৃথিবীতে চিরকাল থাকার জন্য আমি সব কিছু করতে প্রস্তুত আছি। আর এই প্রয়োগ তো আমার কাছে এমনটাই যেন গভীর ঘুমের পর জেগে ওঠা। গুঞ্জনকান্ত যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

—ঠিক আছে। তবে আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিতে সুসজ্জিত গবেষণাগারের একটি বিছানায় প্রফেসর কামীন গুঞ্জনকান্তকে শুইয়ে দেন। গুঞ্জনকান্তের ঠিক সামনে কোন বিশেষ ধরনের ধাতুর তৈরি ক্যাপসুল আকারের একটি বাক্স রাখা ছিল।

—গ্রাফাইট, অ্যালুমিনিয়াম আর কিছু অন্য ধাতুকে মিশিয়ে তৈরি এই বিশেষ বাক্স আপনার শরীরকে তাপমাত্রার উঠা-নামার ধাক্কা আর হেঁচকা টান থেকে রক্ষা করবে। গুঞ্জনকান্তের মন থেকে সমস্ত শঙ্কার অবসান চাইছিলেন প্রফেসর।

– এটাকে জল দিয়ে গিলে ফেলুন, প্রফেসর নীল-সবুজ রঙের একমুঠো ক্যাপসুল আর এক গেলাস জল গুঞ্জনকান্তকে এগিয়ে দেন প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট চর্বি আর ভিটামিনে পরিপূর্ণ এই ক্যাপসুলগুলি অনেক বছর পর্যন্ত আপনাকে শক্তি প্রদান করতে থাকবে। আর যখন আপনি জেগে উঠবেন যখন আপনি ‘গ্র্যান্ড ওল্ড অফ দ্য আর্থ’ হয়ে যাবেন। বলতে বলতে প্রফেসর অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন, কিন্তু গুঞ্জনকান্ত মৃদু হাসেন। উৎসাহ, রোমাঞ্চ আর ভয়—এই তিনের মিশ্রণ ছিল তাঁর হাসিতে।

সম্মোহন আর রসায়নের মিলিত প্রভাবে গুঞ্জনকাস্তের শরীর ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। এ সময় তাঁর প্রিয় স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। সে তাঁকে এই প্রয়োগের জন্য কখনই অনুমতি দিত না। তাই তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় ছেড়ে চুপচাপ চলে আসতে হয়েছিল। সেই সময় তিনি শেষবারের মত স্ত্রীর নিদ্রামগ্ন শান্ত, সরল মুখ দেখেছিলেন। যদি আর একবার তিনি তাকে দেখতে পেতেন। মোহবশত গুঞ্জনকান্ত ছটফটিয়ে ওঠেন।

–এখন আপনি প্রগাঢ় নিদ্রামগ্ন হতে যাচ্ছেন। এটাই শেষ ধ্বনি যা গুঞ্জনকান্ত শুনেছিলেন আর লুপ্ত হওয়া চেতনা তাঁকে সমস্ত সাংসারিক বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়। গুঞ্জনকান্তের অসাড় শরীরকে সাবধানে প্রফেসর কামীন তাড়াতাড়ি বাক্সের ন্যায় ক্যাপসুলটিতে বন্ধ করে দেন। প্রয়োগ সফলভাবে সম্পূর্ণ হওয়ায় প্রফেসর কামীনের মন আনন্দে নেচে ওঠে।

-এই বিচিত্র প্রয়োগের জন্য আমার নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে। এই শতাব্দীর সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পুরস্কার আমিই পাব। প্রফেসর বিড় বিড় করে বারবার একথা বলেন। সফলতার নেশায় চুর সত্তর বছরের দুর্বল হৃদয় প্রসন্নতার এই তীব্র আবেগকে সহ্য করতে না পেরে প্রফেসরের সঙ্গ দিতে ব্যর্থ হয় এবং প্রফেসরের জীবনলীলা সাঙ্গ হয়। ফলে তাঁর এই বিস্ময়কর প্রয়োগ বিশ্ববাসীর কাছে অজানাই থেকে যায়।

সময়চক্রের সুদীর্ঘ আবর্তনের পর একদিন গুঞ্জনকাস্তের সুপ্ত মস্তিষ্কতে চেতনা ফিরে আসে। আর একটা প্রশ্ন তাঁর মাথায় ঘা মারছিল, ‘আপনি কি সুস্থ অনুভব করছেন ?” কেউ যেন তাঁকে জিজ্ঞেস করছিল। তিনি জবাব দেন।

—হ্যাঁ, এবং চোখ মেলে তাকান।

প্লাস্টিকের মত কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি গবেষণাগার মনে হচ্ছিল। চারপাশে অদ্ভুত অদ্ভুত সব যন্ত্র রাখা ছিল, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক বিচিত্র প্রাণী। বিরাট বড় মাথা, দুর্বল হাত-পা আর ঝলসে যাওয়া বীভৎস রঙের ত্বক, মানুষের সঙ্গে মেলে না তার চেহারা। ভয় পেয়ে গুঞ্জনকান্ত চোখ বন্ধ করেন আর মস্তিষ্ক অতীত স্মৃতির দরজায় করাঘাত করে কোথায় ছিলেন, কোথায় ঘুমিয়েছিলেন ? পরমুহূর্তে সমস্ত স্মৃতি মনে পড়তেই তিনি উঠে বসেন।

—আমি কোথায়? তাঁর মনে প্রশ্ন ওঠামাত্রই সেই বিচিত্র প্রাণীটি জবাব দেয়।

—আপনি পৃথিবীতেই আছেন আর প্রায় এক শতাব্দী পরে জেগেছেন। ক্যান্সারের প্রতিষেধক তো বিংশ শতাব্দীর শেষেই আবিষ্কৃত হয়েছিল, কিন্তু ভূগর্ভের অস্থিরতার জন্য ক্যাপসুলে বন্ধ আপনার শরীর অজ্ঞাত স্থানে পৌঁছে গিয়েছিল। যেখানে কেউ তা দেখতে পায়নি এবং সেজনাই আপনাকে এত দীর্ঘ সময় পরে। জাগান হয়েছে।

—আমি বাইরে বেড়াতে যেতে চাই ? গুঞ্জনকান্ত অধীর আগ্রহে ছিলেন তাঁর প্রিয় পরিচিত পৃথিবীকে দেখার জন্য।

তাঁর অচেনা সঙ্গী বলে, ঠিক আছে, কিন্তু বাইরে যাবার আগে এই বিশেষ পোশাক আপনাকে পরতে হবে। গুঞ্জনকান্ত কিছু না বুঝেই সেই পোশাকে নিজের শরীর ঢেকে নেন।

—আপনার শরীর এমন কেন ? যেতে যেতে গুঞ্জনকান্ত সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করেন।

এক বিদ্রূপের হাসি গুঞ্জনকান্তের সঙ্গীর ঠোঁটে ভেসে ওঠে। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই অধিকাংশ কাজ স্বচালিত যন্ত্রের সাহায্যে হচ্ছিল। মানুষ নিজের হাতপায়ের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু মস্তিষ্কের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরিণামস্বরূপ হাত-পা দুর্বল আর মস্তিষ্কের আকারে বৃদ্ধি ঘটে। অচেনা মানুষটি কারণ ব্যক্ত করে।

– আপনার ত্বক এরকম ঝলসে যাওয়া আর বীভৎস রঙের কেন ? গুঞ্জনকান্তের পরবর্তী প্রশ্ন।

-আমাদের বুদ্ধিহীন পূর্বপুরুষরা পৃথিবীকে এত দূষিত করেছিল যে অতিবেগুনি রশ্মিকে আটকাতে সক্ষম ওজোন স্তর ধ্বংস হয়ে যায়। শত চেষ্টাতেও আমরা সেটাকে পুনরায় তৈরি করতে পারিনি। আর সেই ক্ষতিকারক রশ্মির আঘাতে আমাদের ত্বক এরকম বীভৎস এবং ঝলসে গিয়েছে। আর ত্বকের ক্যান্সারের মত রোগ মানুষের শরীরে স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছে।

গুঞ্জনকান্ত’ গভীর অপরাধ ভাবনায় জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না যে, আরও কিছু ভয়াবহ সত্য তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করে আছে।

— সাবধান হয়ে যান। আমরা পৃথিবীর ওপরের স্তরে এসে পড়েছি। সঙ্গীর সাবধান বাণীর সঙ্গে সঙ্গেই গুঞ্জনকান্ত মানুষের ভূগর্ভস্থ বাসস্থান থেকে বার হয়ে পৃথিবীর ওপরের স্তরে পা রাখেন।

কিন্তু একি! তিনি ভয়ার্তভাবে চারিদিক লক্ষ্য করেন। মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে থাকা জনমানবহীন আর ধূসর পৃথিবীতে না আছে কোন প্রাণী না আছে কোন গাছপালা। সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আণবিক আবর্জনা, রেডিওধর্মী ধূলিকণা, বিনা বাধায় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির আনাগোনা এবং এক ভয়াবহ নির্জনতা।

বিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিমান মানুষের নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস, পরমাণু বিস্ফোট আর শিল্পের ব্যাপক উন্নতির নামে ক্ষতিকারক রসায়নের ব্যবহার করে পরিবেশকে এতো বেশি দূষিত করেছিল। যে জীব-শৃঙ্খল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রকৃতিকে শোষণ করতে করতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যখন পৃথিবী থেকে গাছপালা আর অন্যান্য প্রাণী চিরদিনের জন্য লুপ্ত হয়েছিল। পরিবেশ এতটাই বিষাক্ত হয় যে পৃথিবীতে মুক্ত বাতাসে কোন প্রাণীর বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

বর্তমানে মানুষ গবেষণাগারে অক্সিজেন তৈরি করে আর কৃত্রিম শক্তিবর্ধক ক্যাপসুল খেয়ে নিজেদের শারীরিক প্রয়োজন মেটায়। পৃথিবীর দূষিত পরিবেশ থেকে বাঁচার জন্য তারা বিশেষভাবে তৈরি ভূগর্ভস্থ বাসস্থানে থেকে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করে চলছে। কিন্তু এভাবেই বা আর কতদিন মানব জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যাবে! একদিন না একদিন তো তাকেও অন্য প্রাণীদের মত লুপ্ত হতে হবে। পৃথিবীকে এইভাবে প্রাণবিহীন করার জন্য দায়ী তো স্বয়ং মানুষই।

গুঞ্জনকাস্তের শরীর নিজের প্রতি ঘৃণা, লজ্জায় থরথর করে কেঁপে ওঠে। তার চেনা পৃথিবীতে তো প্রাণীরা নির্ভয়ে বিচরণ করত, পাখিরা কলরব করত, নদী কলকল শব্দে প্রবাহিত হত, সবুজে ভরা উপত্যকা গুনগুন করত, আর পর্বত মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকত। শীতল, সতেজ সেই বাতাস এখন কোথায়, যা তার মধ্যে বেঁচে থাকার অদম্য লালসা জাগিয়ে রেখেছিল।

নিজেদের বংশধরদের জন্য এ কেমন উপহার রেখে গেছে মানুষ! মানুষের প্রতি নিজের স্নেহ বিলিয়ে দেওয়া প্রকৃতি আজ ভয়ানক আর নির্মম মৃত্যুর রূপ ধারণ করেছে। এমন পৃথিবীতে সে আর এক মুহূর্তও বেঁচে থাকতে চায় না। কিছুতেই নয়। সংসারে একা থেকে যাওয়ার অনুভূতি সহসাই যেন তাঁর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। তিনি নিজের পরিহিত বিশেষ পোশাক খুলে ফেলেন আর দেখতে দেখতে ওত পেতে থাকা নির্মম মৃত্যু তাঁকে নিজের কোলে টেনে নেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *